বনভূমি মৃত্তিকা

বনভূমি মৃত্তিকা (Forest Soil) বনভূমির বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৃত্তিকা। অন্যভাবে বলতে গেলে, এক প্রকারের ভূমি ব্যবহার এবং কোন অবস্থাতেই নির্দিষ্ট মৃত্তিকা বা মৃত্তিকা গ্রুপের ধর্মাবলি নয়। অন্যান্য মৃত্তিকার মতোই বনভূমি মৃত্তিকার ধর্মাবলি নিয়ন্ত্রণকারী প্রধান নিয়ামতগুলো হলো কোন এলাকার ভূসংস্থান, উচ্চতা, গ্রথন, পানি ও তাপমাত্রা। ভূমি ব্যবহার, বিশেষ করে কোন এলাকায় অরণ্যের বিস্তৃতি অবশ্যই পৃষ্ঠমৃত্তিকার রঙ, জৈব পদার্থের পরিমাণ, জীবের দ্বারা মৃত্তিকার উলটপালট হওয়া, সংযুতি গঠন ইত্যাদির মতো মৃত্তিকা ধর্মকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে।

একটি বিষয় কল্পনা করা যায় যে, মৃৎজনিক অতীতকালে পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা কোন না কোন অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। কিন্তু কৃষিকাজের জন্য ভূমির প্রয়োজন মিটানোর নিমিত্তে অনেক প্রাকৃতিক অরণ্য কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সভ্যতার অগ্রগতি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস হতে থাকে এবং কৃষিকাজ, নগরায়ণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্পের অগ্রগতি ইত্যাদি কাজে মৃত্তিকার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী বনাঞ্চলগুলো কেবল সেসব এলাকায় অবস্থিত যেখানে বনভূমি ব্যতীত অন্য কোন কাজে ভূমি ব্যবহারে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উল্লিখিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়: (১) উপকূলীয় অঞ্চলের তটীয় অরণ্য, (২) স্বাদুপানি এলাকার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত অরণ্য, (৩) ভাওয়াল-মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্দেশীয় পর্ণমোচী অরণ্য, (৪) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি এলাকার মিশ্র ক্রান্তীয় অরণ্য এবং (৫) বসতবাড়ি ও সামাজিক অরণ্য। প্রতিটি বনভূমি মৃত্তিকা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো।

তটীয় অরণ্য অঞ্চল  বাংলাদেশে এ শ্রেণির বনভূমিতে অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলো হলো: (ক) সুন্দরবন (০.৬৭ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা) (খ) আবাদি উপকূলীয় অরণ্য (১০০,০০০ হেক্টর) এবং (গ) চকোরিয়া সুন্দরবন (৮০০০ হেক্টর)। এ কারণে প্রতিটি বনভূমি মৃত্তিকার বেশ কিছু ধর্ম একই রকমের থাকে, যেমন জোয়ারের ঈষৎ লোনা পানি (brackish) দ্বারা প্লাবিত হওয়া, অত্যন্ত দুর্বল নিষ্কাশিত অবস্থা, মিহি দোঅাঁশ থেকে এঁটেল গ্রথন এবং পানি দ্বারা প্রভাবিত ধর্মাবলি। তটীয় অরণ্য মৃত্তিকার বিভিন্নমুখী বৈশিষ্ট্যকে বিভিন্ন বনভূমি অঞ্চলের জন্য আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়। বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার যে অংশটি সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত সে অঞ্চলটি গঙ্গা পললভূমি পললে অবস্থিত। এ এলাকার মৃত্তিকা ধূসর থেকে গাঢ় ধূসর, সামান্য থেকে মধ্যম চুনযুক্ত এবং ঈষৎ ক্ষারীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন এঁটেল। আবাদি তটীয় বনভূমি মৃত্তিকা পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার গঙ্গা নদীর পললে পাওয়া যায়। এ এলাকার মৃত্তিকা দোঁআশ থেকে এঁটেল গ্রথনের, চুনযুক্ত এবং দুর্বল নিষ্কাশিত মেঘনার মিলনস্থল হতে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হলে চুনের পরিমাণ হ্রাস পায়, অন্যদিকে ভোলা জেলার পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে মৃত্তিকাতে পলিকণার পরিমাণ হ্রাস পায়। চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমতলভূমির মৃত্তিকা চট্টগ্রাম, ফেনী ও কক্সবাজার জেলায় পাওয়া যায়। এসব মৃত্তিকা জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়, রং ধূসর, চুনহীন এঁটেল বা মিহি দোঅাঁশ গ্রথন সম্পন্ন। চকোরিয়া সুন্দরবনের মৃত্তিকা মাতামুহুরী নদীর বদ্বীপ এলাকায় পাওয়া যায়। একারণে খুলনা সুন্দরবন এলাকার মৃত্তিকার চেয়ে এ এলাকার মৃত্তিকা অধিক ক্ষালিত এবং এসব মৃত্তিকাতে সর্বাপেক্ষা কম পরিমাণে অবক্ষয়যোগ্য মণিক বিদ্যমান। নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে এ এলাকার মৃত্তিকার অম্লত্ব স্থানীয়ভাবে অনেক বেড়ে যেতে পারে (পিএইচ ৩.৫ এর কম), কারণ জোয়ারের লবণাক্ত পানিবাহিত সালফাইডের জারণের কারণে সালফিউরিক এসিড উৎপন্ন হয়। ফলে মৃত্তিকা কৃষিকাজের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে যায়। চকোরিয়া সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা বর্তমানে পরিষ্কার করে চিংড়ি চাষ, লবণ ক্ষেত্র ও কৃষি কাজের আওতায় আনা হয়েছে। গরানজাতীয় বন প্রজাতির বৃক্ষ স্থানীয়ভাবে কোন কোন বিচ্ছিন্ন এলাকায় দেখা যায়। বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ তটীয় বনভূমিতে বিদ্যমান গাছের প্রজাতিগুলো হলো সুন্দরী, ঘেওয়া, পশুর, গরান, গোলপাতা, কেওড়া, কাকরা (kakra) ইত্যাদি।

সুন্দরবনের মৃত্তিকাকে যদি বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি দ্বারা প্লাবিত হওয়া থেকে রক্ষা করা যায় তবে বাঁধ দিয়ে উদ্ধারকৃত অন্যান্য মৃত্তিকার মতো এসব এলাকাও আউস ও রোপা আমন ধান চাষ করা যেতো। জোয়ার দ্বারা সৃষ্ট প্লাবন, লবণাক্ততা, বাঘ, গোখুরা সাপ, কুমির ও অজগর সাপ এবং ম্যালেরিয়ার আক্রমণের কারণে সম্ভবত সুন্দরবনকে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য কেটে ফেলা হয় নি। সুন্দরবন এবং উপকূলীয় বনাঞ্চল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় স্থানীয় জনসাধারণের জান-মাল রক্ষা করে। অনিকন্তু, এসব বনাঞ্চলের পরিবেশগত গুরুত্বও অনেক। বর্তমানে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবনের অন্তর্গত মোট এলাকার পরিমাণ প্রায় ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার।

স্বাদুপানি জলাভূমির বনাঞ্চল  খুলনা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং সিলেট জেলার হাওর এলাকায় অবস্থিত। স্বাদুপানি জলাভূমি বনাঞ্চলের মৃত্তিকা দুর্বল থেকে অতিদুর্বল নিষ্কাশিত, গাঢ় থেকে গাঢ় ধূসর এঁটেল। এসব মৃত্তিকা যখন শুকিয়ে যায় তখন অত্যন্ত অম্লীয় বিক্রিয়া প্রদর্শন করে। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও খুলনা জেলার মৃত্তিকাগুলো গাঢ় ধূসর, চুনযুক্ত ক্ষারীয় এঁটেল। এসব মৃত্তিকা প্রতিবছর মৌসুম মাফিক ছয় মাস প্লাবিত থাকে।

মৌসুম মাফিক গভীরভাবে প্লাবিত হওয়ার কারণে মৃত্তিকাগুলো অজৈব পুষ্টি উপাদানে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কৃষিকাজে এদের ব্যবহার সীমিত। স্বাদুপানি জলাভূমি বনাঞ্চলের বৃহদংশ যেখানে কড়ই, পিটালি, বরুন, হিজল, বাটরা এবং বিভিন্ন প্রজাতির মস, হোগলা ও নলখাগড়া ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাপের কারণে বর্তমানে সেসব স্থান পরিষ্কার করে বোরো ধানের চাষ করা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাংশে জলাভূমি বনাঞ্চল কেটে ফেলার ফলে দ্রুত পলি জমা হওয়ার কারণে জলাধারের পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস, প্রতি একক এলাকাতে মাছ উৎপাদন হ্রাস, জলাভূমির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অবনয়ন এবং ভাটি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার প্রাদুর্ভাবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভাওয়াল-মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্দেশীয় পর্ণমোচী বনভূমি  অন্তর্দেশীয় পর্ণমোচী বনাঞ্চল ভূতপূর্ব ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার প্রায় ০.১২ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এ ধরনের বনভূমির প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি হলো শাল। এ বনভূমিতে জন্মে এমন অন্যান্য গাছের প্রজাতিগুলো হলো কড়ই, জারুল, বাটরা, বহেরা, শিমুল, শিদা (shida), বয়রা, কুম্বি ইত্যাদি। গত কয়েক দশক যাবৎ শাল গাছের নির্বিচার কর্তন এবং চাষাবাদের জন্য বনভূমি অবৈধভাবে দখল করে নেওয়ার কারণে বনাঞ্চল মারাত্মকভাবে গাছশূন্য হয়ে পড়েছে।

ভাওয়াল-মধুপুর এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের মৃত্তিকার মধ্যে বাদামি সোপান মৃত্তিকা, ধূসর সোপান মৃত্তিকা ও ধূসর উপত্যকা মৃত্তিকা অন্তর্ভুক্ত। এ তিন প্রকার মৃত্তিকার মধ্যে পর্ণমোচী শালবন প্রধানত বাদামি পাহাড়ি মৃত্তিকাতে জন্মে। বাদামি বনভূমি মৃত্তিকাগুলো সুনিষ্কাশিত, অম্লীয় এবং এদের গ্রথন এঁটেল থেকে মিহি দোঅাঁশ। ভাওয়াল-মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলে এসব মৃত্তিকার গভীরতার পরিসর অগভীর অবক্ষয়িত সোপানে ৫০ সেন্টিমিটার থেকে গভীর অবক্ষয়িত সোপানে কয়েক মিটার পর্যন্ত।

উঁচুভূমি সোপান মৃত্তিকাকে স্থানীয়ভাবে ‘চালা’ এবং নিচু এলাকার মৃত্তিকাকে ‘বাইদ’ বলা হয়। অসম্পূর্ণভাবে নিষ্কাশিত সমতল উঁচুভূমি এবং নিচু এলাকাতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে ধান চাষ করা হয়। সুনিষ্কাশিত বাদামি ‘চালা’ মৃত্তিকার দ্রুত পানি প্রবেশ্যতা ধর্মের কারণে ধান চাষের জন্য অনুপযুক্ত  হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একারণে এসব মৃত্তিকা শাল বনের জন্য রেখে দেওয়া হয়। উন্নত প্রযুক্তি ও গভীর নলকূপের দ্বারা সেচের পানি লভ্য হওয়ার কারণে উঁচুভূমির ‘চালা’ মৃত্তিকাকে সারা বছর ধরে বিভিন্ন প্রকার রবি ও খরিফ শস্য জম্নানোর উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া, মধ্যম থেকে অধিক পুষ্টি উপাদান সংবলিত চালা মৃত্তিকাগুলো সাময়িক সেচসহ বা সেচ ব্যতীত উদ্যান শস্য, যেমন- কলা, আনারস, পেঁপে, আম, বেল রান্নায় ব্যবহূত বন্য গুল্ম বিশেষ, ইত্যাদি জন্মানোর উপযোগী।

জামালপুর ও জামালপুর জেলার উত্তরে অঘন শাল বন আবৃত পাহাড়ি এলাকার পর্ণমোচী বনভূমি প্রায় ১২,০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এসব পাহাড় প্রকৃতপক্ষে ডুপি-টিলা (Dupi-Tila) ও দিহিং সিরিজে অন্তভুক্ত এবং সুস্পষ্টভাবে প্রশস্থ উপত্যকা দ্বারা ব্যবচ্ছিন্ন।

ডুপি-টিলা স্তরসমষ্টিতে অন্তর্ভুক্ত পাহাড়ি মৃত্তিকার সম্পূর্ণ পরিলেখ সুনিষ্কাশিত, বাদামি, স্থূল থেকে মিহি দোঅাঁশ গ্রথন এবং অম্লীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন। ডিহিং স্তরসমষ্টির মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য ডুপি টিলা মৃত্তিকা সদৃশ, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এ ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এই যে, এসব মৃত্তিকাতে মিহি বস্ত্তর মধ্যে বড় আকারের নুড়ি ও নদীবাহিত প্রস্তরখন্ড অনুপ্রবিষ্ট থাকে। ব্যবসায়িক স্বার্থে নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে স্থানীয়ভাবে ঠিকাদারগণ এসব পাথর সংগ্রহ করে।

সঠিক ব্যবস্থাপনার দ্বারা এসব এলাকার মৃত্তিকাতে ফলের বাগান, শিল্পকারখানায় ব্যবহূত গাছপালা যেমন- চা, রাবার, ওয়েল পাম ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে। এছাড়া অধিক মূল্যবান কাঠ পাওয়া যায় এমন প্রজাতির গাছও লাগানো যেতে পারে।

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকার মিশ্র ক্রান্তীয় বনভূমি  মিশ্র ক্রান্তীয় বনভূমি ভূতপূর্ব সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তৃত। এ ধরনের বনভূমিতে অন্তর্ভুক্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১৮০৭৯ বর্গকিলোমিটার। পাহাড়গুলো টিপাম-সুরমা (+৫০%) এবং ডুপি-টিলা (+৪০%) শিলাদল নিয়ে গঠিত। বাকি অংশ উপত্যকা ও নদীজাত পাললিক সমভূমির পলল মৃত্তিকা, দিয়ে গঠিত। পাহাড়ি এলাকার বনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নিচু ঢালের আর্দ্র চিরসবুজ বন, (খ) উঁচু ঢালে অবস্থিত আংশিক চিরসবুজ বন, (গ) উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঈষৎ-আর্দ্র পর্ণমোচী বন এবং (ঘ) মৃদু খাড়া ঢালু ভূমিসহ উঁচু পাহাড়ের উপর উন্মুক্ত পর্ণমোচী বন। বাঁশ ও বিচ্ছিন্ন সাভানা বন কোথাও কোথাও অমিশ্রিত এবং অন্যত্র অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় স্থানীয়ভাবে পরিলক্ষিত হয়। দুর্বল নিষ্কাশিত উপত্যকা এবং সমতল নদীজ পললে ধান চাষ করা হয়।

টিপাম-সুরমা শিলাদলের উঁচু পাহাড়ি মৃত্তিকা অগভীর (+ ৫০ সেন্টিমিটার গভীর), অতিমাত্রায় নিষ্কাশিত, বাদামি মিহি দোঅাঁশ থেকে স্থূল দোঅাঁশ এবং অম্লীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন যা সংহত বা অসংহত কর্দমশিলা) বস্ত্তর উপর অবস্থিত। ডুপি-টিলা পললে উৎপন্ন নিচু পাহাড়ি মৃত্তিকা পাহাড়ের উভয় পাশে সৃষ্ট উত্তলভঙ্গের (anticline) সানুদেশ দখল করে আছে। এসব মৃত্তিকা সুনিষ্কাশিত, অত্যন্ত বাদামি, সুদৃঢ় সংযুতিসম্পন্ন অম্লীয় বিক্রিয়া সংবলিত গভীর মৃত্তিকা। মৃত্তিকার অগভীরে ল্যাটারাইটীয় বস্ত্ত, প্রকীর্ণক ক্ষিতিজ বা প্লিনটাইটিয় অনুস্তরণজাত গুটি দ্বারা যতক্ষণ পর্যন্ত না বিঘ্নিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এসব মৃত্তিকা বন প্রজাতির বিভিন্ন বৃক্ষ, উদ্যান শস্য প্রজাতি এবং শিল্পকারখানায় ব্যবহূত হয় এমন গাছপালা, যেমন- রাবার, চা, ফলের বাগান, অয়েল পাম, কফি ইত্যাদি জন্মানোর উপযোগী।

পাহাড়ি মৃত্তিকাগুলো ভৌত-রাসায়নিক ও অজৈব পুষ্টি উপাদানের পরিমাণের দিক থেকে মধ্যম মাত্রায় উর্বর, কিন্তু খাড়া ঢাল ও অগভীর পরিলেখের কারণে এসব মৃত্তিকা প্রথাগত কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী। তৎসত্ত্বেও, স্থানীয় জনসাধারণ প্রতি বছর ঢালু পাহাড়ি ভূমির প্রায় ৫০,০০০ হেক্টর বর্তমানে জুম চাষে (স্থানান্তরিত কৃষিকাজ) ব্যবহার করে এবং ৫ থেকে ৬ বছরের জুম-চক্র অনুসরণ করে। সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার হেক্টর উদ্যান শস্য, ২০ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর চা এবং ২০ থেকে ২৫ হাজার হেক্টর রাবার চাষের অন্তর্ভুক্ত। বাকি ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর ভূমিসংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে শ্রেণিবিহীন বন রয়েছে। ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহূত পাহাড়ি মৃত্তিকার উপর জন্মানো বনবৃক্ষের প্রজাতিগুলো হলো গজারী, ধাকিজাম, চম্পা, কড়ই, তেলসুর, জারুল, কদম, শিমুল, বহেরা, চাপালিশ, বাঁশ ইত্যাদি। অধিক গভীরতা সম্পন্ন মৃত্তিকা তুলনামূলকভাবে নিচু ঢালে অবস্থিত এবং পাহাড়ের এ নিচু এলাকা ফলের গাছ, উদ্যান শস্য প্রজাতি জন্মানোর জন্য অধিক সম্ভাবনাময় এবং পাহাড়ের পাদদেশীয় মৃত্তিকাকে রপ্তানিমুখী জৈব কৃষি এবং কলা ও আনারস চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। দুর্গম এলাকার উঁচু পাহাড়ি মৃত্তিকা এবং  D-শ্রেণির ঢাল সংবলিত ভূমিকে নিয়ন্ত্রণাধীন প্রাকৃতিক বনের জন্য রেখে দেওয়াই সর্বোত্তম ভূমি ব্যবহার।

বসতবাড়ি ও সামাজিক বন  বাংলাদেশে মোট ২.১ মিলিয়ন হেক্টর এলাকাতে মানুষ উদ্ভাবিত মৃত্তিকা (anthropogenic soils) বিদ্যমান। এসব মৃত্তিকার মধ্যে মানুষের তৈরি ভূমি (০.১ মিলিয়ন হেক্টর) ও বিবিধ ভূমি (২.০ মিলিয়ন হেক্টর) অন্তর্ভুক্ত। বিবিধ ভূমির মধ্যে প্রায় ২০০,০০০ কিলোমিটার সড়ক, ৭০০০ কিলোমিটার নদীর বাঁধ এবং ৬০০০ কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া অসংখ্য সেচ ও নিষ্কাশন খাল রয়েছে। খাদের পাড়ে বিক্ষিপ্তভাবে গাছ লাগানো হয়েছে। মানুষের তৈরি ভূমির প্রায় ০.৩০ মিলিয়ন হেক্টর বর্তমানে সামাজিক বনের আওতাধীন।

মানুষের তৈরি মৃত্তিকা এবং বিবিধ ভূমি সকল প্রকার ভূ-ভৌত উৎস বস্ত্তর ইউনিটে বিদ্যমান। এ কারণে উৎস বস্ত্তর ইউনিটের ভূমিরূপ, ভূতত্ত্ব ও ভূপ্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এসব মৃত্তিকাতে দেখা যায়। তৎসত্ত্বেও, এসব মৃত্তিকার নিষ্কাশন ব্যবস্থা পললভূমি এলাকার মৃত্তিকার তুলনায় অধিক অবাধ। মানুষ উদ্ভাবিত উঁচু এলাকার মৃত্তিকা সন্নিকটবর্তী এলাকার তুলনায় অধিকতর সমতল ভূমিতে বিদ্যমান এবং জৈব পদার্থ ও ফসফরাসের পরিমাণের দিক থেকে অধিকতর সমৃদ্ধ। বসতবাড়ি এলাকার মৃত্তিকাগুলোর অধিকাংশই সন্নিকটবর্তী মৃত্তিকার তুলনায় বেশি উর্বর, অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অত্যধিক উৎপাদনশীল। [মীর মোহাম্মদ হাসান]