বড় শরীফপুর মসজিদ

বড় শরীফপুর মসজিদ  কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার বড় শরীফপুর গ্রামে নটেশ্বর দিঘি নামে পরিচিত একটি বড় দিঘির পূর্বতীরে অবস্থিত। ১৯৫৯ সালে মসজিদটিকে সংরক্ষিত ইমারত হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে এর কিছুটা সংস্কার করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক মসজিদটির আরও সংস্কার করা হয়। অলংকৃত খোপ নকশা (Panel) সমূহের আদিরূপ ফিরিয়ে আনার জন্য এ সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে মসজিদটি সংরক্ষিত অবস্থায় বিদ্যমান।

বড় শরীফপুর মসজিদ, কুমিল্লা

আয়তাকার মূল মসজিদটি একটি নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর পূর্ব দিকে রয়েছে একটি সংস্কারকৃত প্রবেশ তোরণ। বাইরের দিকে মসজিদটির পরিমাপ ১৪.৪৮ মি × ৫.৯৪ মি। ইমারতটিকে মজবুত করতে বাইরের দিকে চারকোণে চারটি বিশাল অষ্টভুজাকার পার্শ্ববুরুজ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ- পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে। শেষোক্ত দুটি প্রবেশপথ অবশ্য লোহার তৈরি জালি (Grille) দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পার্শ্ববুরুজগুলি ছাদ ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে পদ্মকলস নকশার ফিনিয়াল শোভিত ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ। পূর্ব দিকের প্রবেশ পথগুলি অর্ধগম্বুজ আচ্ছাদিত ভল্টের নিচে। বাইরের দিকের খিলানগুলি বহুখাঁজ বিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং এটি দেয়াল থেকে বহির্গত একটি প্রক্ষেপণের মধ্যে স্থাপিত। এ প্রক্ষেপণের দুই প্রান্তে রয়েছে অষ্টভুজাকার ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার (Turret)। পূর্ব দিকের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অষ্টকোণাকার মিহরাব। প্রতিসাম্য বজায় রাখার জন্য এখানেও কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড় এবং এর বাইরের দিকে রয়েছে দুটি ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার শোভিত একটি প্রক্ষেপণ।

দেয়ালের গায়ে সংলগ্ন ইটের তৈরি স্তম্ভের উপর থেকে আড়াআড়িভাবে নির্মিত দুটি প্রশস্ত খিলান মসজিদের অভ্যন্তরভাগকে তিনটি ‘বে’-তে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যবর্তী ‘বে’-টি বর্গাকার এবং পাশের দুটি আয়তাকার। তিনটি ‘বে’র উপরেই আচ্ছাদন হিসেবে রয়েছে সামান্য কন্দাকৃতির (bulbous) গম্বুজ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড়। অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত গম্বুজগুলির শীর্ষে রয়েছে পদ্মকলস শোভিত ফিনিয়াল। গম্বুজগুলির ভার বহনের জন্য অবস্থান্তর পর্যায়ে (phase of transition) লালবাগ দুর্গের মসজিদ এবং ঢাকার সাতগম্বুজ মসজিদে ব্যবহূত পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়েছে।

সমান্তরাল বপ্র এবং তার উপরে গম্বুজের নিম্নাংশের অষ্টভুজ ড্রাম বদ্ধ মারলোন (blind marlon) নকশা দিয়ে অলংকৃত। গম্বুজের ভেতরের দিকে নিম্নাংশ ঘিরে রয়েছে পাতার নকশা। আর এর শীর্ষে রয়েছে বৃহদাকার চক্রনকশা। ছাঁচে ঢালা ব্যান্ড নকশার সাহায্যে কয়েকটি অংশে বিভক্ত অষ্টভুজাকার পার্শ্ববুরুজ-সমূহের ভিত্তিতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কলস-নকশা। পূর্ব দিকের ফাসাদটি খিলানকৃত গভীর খোপ-নকশার সাহায্যে চমৎকারভাবে অলংকৃত। মিহরাবত্রয়ের খিলানগুলির বাইরের দিক বহু খাঁজবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় মিহরাবের আয়তাকার ফ্রেমের উপরে রয়েছে বদ্ধ পদ্মপাপড়ি নকশার একটি সারি। পুরো মসজিদটির ভেতরের অংশ বর্তমানে পলেস্তারায় আচ্ছাদিত এবং চুনকাম করা।

একটি বড় গম্বুজ এবং তার দুই পাশে দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজবিশিষ্ট এ পরিকল্পনা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মসজিদটি মুগল বাংলার মসজিদ স্থাপত্যের অতিপরিচিত রূপটিই তুলে ধরেছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের উপর একটি এবং কেন্দ্রীয় মিহরাবের উপর স্থাপিত আরেকটি ফারসি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, জনৈক মুহম্মদ হায়াত আবদ করিম ১৭০৬-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। প্রচলিত মতানুসারে, তিনি ছিলেন এ এলাকার কোতোয়াল। মসজিদটি তাই কোতোয়ালী মসজিদ নামেও পরিচিত।  [এম.এ বারি]