বঙ্গীয় রেনেসাঁ
বঙ্গীয় রেনেসাঁ উনিশ শতকে বঙ্গদেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন সুচিত হয়। এ পরিবর্তনকে বঙ্গীয় রেনেসাঁ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। প্রথমত, কতিপয় ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও মিশনারি এবং স্থানীয় বিদ্বজ্জনদের মধ্যে যোগাযোগ-সংশ্লেষের ফলে এ পরিবর্তন দেখা দেয়। এ রেনেসাঁর উদ্ভব কলকাতায়।
সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, ১৮৩০ সালের আগে এখানে পাঠ্যপুস্তক রচনাসহ ইউরোপীয় শিক্ষাপদ্ধতি ও ছোট-বড় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠা তার একটি বড় নিদর্শন। কলকাতার উচ্চশ্রেণীর লোকেরা এটি গড়ে তোলেন। এটি ছিল তখন সমগ্র এশিয়ায় ইউরোপীয় আদলে উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। এ সময়ে কলকাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে সংবাদপত্র, সাময়িক পত্রিকা এবং বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থ নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। কলকাতায় একটি সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্রমশ বিদ্বজ্জনেরা আধুনিক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। সেসঙ্গে নিজেদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার এবং ইউরোপীয় ঘটনাবলি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকেও মনোযোগ দেন। এভাবে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনমনেও সচেতনতা বেড়ে চলে।
আধুনিকতার ইতিবাচক বিষয়গুলির ওপর যেসব ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রভাব বিস্তার করেন, প্রধানত তাঁরা ছিলেন স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন কিছু সরকারি, সামরিক ও বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কিছু মিশনারি। ইতিহাসের পরিভাষায় এঁদের বলা হয়েছে প্রাচ্যবিদ। এঁরা অষ্টাদশ শতকের যুক্তিবাদ, ধ্রুপদীচিন্তা এবং উদার আন্তর্জাতিকতায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মরত ইউরোপীয়দের থেকে এ প্রাচ্যবিদেরা একটি আলাদা বিদ্বৎ গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য হন। এ বিদ্বানদের স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে একটি হচ্ছে, এঁরা অন্তত একটি স্থানীয় ভাষা আয়ত্ত করে তা তাদের গবেষণার কাজে প্রয়োগ করেন। উইলিয়ম জোনস, হেনরি টমাস কোলব্রুক, উইলিয়ম কেরী, হোরেস হেম্যান উইলসন এবং জেমস প্রিন্সেপ ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাস বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ প্রাচ্যবিদেরা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে বিশ্বজনীন রাখার চেষ্টা করেন। জাতিভেদের প্রাচীর তুলে তাঁরা শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেননি। বস্ত্তত, প্রাচ্যবিদেরা বাঙালি বিদ্বানদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাঁদের কাছে নিজেদের তুলে ধরেন ইউরোপীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উৎস হিসেবে। তাঁরা দেশীয় বিদ্বানদের সঙ্গে মিলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন।
গভর্নর-জেনারেল ওয়েলসলি ১৮০০ সালে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও স্থানীয় বিষয় সম্পর্কে শিক্ষাদানের উদ্দেশে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপন করেন। কলেজটি প্রাচ্যবিদদের কর্মকান্ডের অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে। এ প্রতিষ্ঠান ছিল ইউরোপীয়দের গড়ে তোলা প্রথম উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র, যেখানে দেশীয় পন্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং তাঁদেরকে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের কাজে উৎসাহিত করা হয়। শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে প্রাচ্যবিদদের সমর্থন আদায় করে এ কলেজ কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি এবং উইলিয়ম কেরীর শ্রীরামপুর মিশনকে ভারতীয় সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভিঘাতের ফলে এ সময় (১৮০০-১৮৩০) বাঙালি বিদ্বজ্জনদের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে একটা টানাপোড়েন লক্ষ করা গেলেও আশাবাদী একটি গোষ্ঠী, ভিনদেশীয় ভাবধারা এবং অসন্তোষজনক দেশীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস চালান। তাঁরা ইউরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ফলকে দেশীয় সাজে ব্যবহার করার উদ্দেশে ব্রিটিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং মিশনারিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে প্রাচ্যবিদদের চিন্তাভাবনা ও জীবনধারাও অনেকটা ভারতীয় হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে সহায়ক হয় ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে স্থানিক দূরত্ব। এভাবে প্রাচ্যবিদদের আমলে পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে ভারতীয় মনোভাব অনুকূল হলে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা ভারতীয় সভ্যতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে বাঙালি বিদ্বানদের মনে ইতিবাচক প্রত্যাশার জন্ম দেয়।
অর্জিত এ ইতিবাচক অবস্থা সত্ত্বেও বাঙালি বিদ্বানেরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বঙ্গীয় রেনেসাঁ সম্পর্কে প্রথম দিকে কিছুটা অনিশ্চিত ছিলেন। দুটি ভিন্ন ধরনের সভ্যতার যোগাযোগ ও সংঘাত এবং নবআবিষ্কৃত ঐতিহাসিক মাত্রা রেনেসাঁর ধারণাকে গতিশীল করলেও তার মধ্যে একটি অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন রকম। একদিকে বাঙালি বিদ্বানেরা প্রাচ্যবিদদের কাছ থেকে প্রথম অবহিত হন ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে; অপরদিকে মিশনারিদের নিকট থেকে জেনেছেন প্রোটেস্ট্যান্টদের মনোভাব, যাঁরা ইতোমধ্যে ইউরোপের মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ দুটি ধারণা রেনেসাঁর সৌষম্য মানবতাবাদ সম্পর্কে বাঙালিদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁরা সনাক্ত করেন, নেতিবাচক ঐতিহাসিক কারণে তাঁদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে; এবং এ ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত হওয়া সম্ভব, তাঁরা নিজেরা যার প্রতিনিধি।
উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁকে বাঙালি বিদ্বানেরা পদ্ধতিগতভাবে চারটি পর্বে গড়ে তোলেন। প্রথমত, তাঁরা বাংলা গদ্যভাষা ও নতুন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বর্ণযুগ নামে আখ্যাত ধ্রুপদী যুগের পুনরাবিষ্কার করেন যার সঙ্গে রয়েছে গ্রিস ও রোমের গৌরবময় ঐশ্বর্যের সমতুল্যতা সনাক্তকরণ। তৃতীয়ত, ভারতীয় বিদ্বানেরা নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থার সঙ্গে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের দেওয়া প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যার সাদৃশ্য লক্ষ করেন। চতুর্থত, বৈশ্বিক প্রগতি সম্পর্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উপনীত হন যার ওপর নির্ভরশীল ছিল তাঁদের প্রত্যাশা। সত্য যে, এ নতুন প্রত্যাশার ধারায় তাঁরা অতীতকে পুনরুদ্ধার করতে অনাগ্রহী কিন্তু ভবিষ্যতের মধ্যে স্বর্ণযুগকে তুলে ধরতে সচেষ্ট।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়ম কেরীকে ১৮০১ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে এবং সমকালের প্রযুক্তিসহ তাঁকে সবরকম আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ এবং সুযোগ্য বাঙালি পন্ডিতদের সহকারি হিসেবে পেয়ে কেরী নিজেকে অত্যন্ত ঈর্ষণীয় অবস্থানে দেখতে পান। তাঁর কাছে দেশীয় সংস্কৃতির বিস্মৃত ঐশ্বর্য তুলে ধরতে পারবেন এবং দেশীয়দের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে রাজি হবেন, উইলিয়ম কেরী এমন একদল সাংস্কৃতিক সমন্বয়কারি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কলেজে তাঁর নিয়োগের ফলে তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
উইলিয়ম কেরী ১৮০১ সালে প্রথম বেঙ্গলি গ্র্যামার নামে একটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। পাঁচটি সংস্করণ হয়েছিল এ গ্রন্থের। এ বছরই তিনি বিভিন্ন পরিবেশে কথাবার্তা বলার নমুনা সংগ্রহ করে কথোপকথন নামে আর-একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইউরোপীয়রা সেকালে যেসব গ্রন্থ রচনা করেন, তার মধ্যে এটিই সম্ভবত প্রথম, যাতে ভারতীয় সংস্কৃতির অভিজাত দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। এতে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়ী, জেলে, মহিলা, দিনমজুর, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, বাচনভঙ্গি, তাদের রীতিনীতি সূক্ষ্ম এবং সহানুভূতিশীল পর্যবেক্ষণের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে গণ্য হয়েছে। এ গ্রন্থটির জন্য কেরীকে ভারতবর্ষের প্রথম সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করা যেতে পারে।
কেরীর রচনায় প্রভাবিত হন রামকমল সেন। তাঁকে বলা যায় বাঙালি বিদ্বজ্জনদের মধ্যে প্রথম রেনেসাঁস-পন্ডিত। তিনি জন্মেছিলেন হুগলির একটি গ্রামে এবং তাঁর পিতা ছিলেন ফার্সি ভাষায় প্রাজ্ঞ। রামকমল সেন সাত বছর বয়সে কলকাতায় আসেন এবং সংস্কৃত, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষা শেখেন। তাঁর এ শিক্ষা তাঁকে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি প্রাচ্যবিদদের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করেন এবং তাঁদের প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। বিশেষত, তিনি হোরেস হেম্যান উইলসনের বন্ধুত্ব লাভ করেন; আর উইলসন এ উৎসাহী বিদ্বানকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। অপরদিকে আর্থিকভাবেও তিনি খুব স্বচ্ছল হন। রামকমল সেন ১৮৪৪ সালে মৃত্যুর সময় দশ লাখ টাকার সম্পত্তি রেখে যান।
রামকমল সেন ১৮৩৪ সালে প্রথম ইংরেজি-বাংলায় একটি আধুনিক অভিধান প্রকাশ করেন। যেসব ইংরেজ পন্ডিত ও কর্মকর্তারা বাংলা ভাষা এবং স্থানীয় রীতিনীতির প্রতি অনুকূল সাড়া দিয়েছেন, তিনি তাঁদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেন। একই বছর প্রকাশিত এ অভিধানের দ্বিতীয় ভাগে। তিনি উইলিয়ম কেরীকে বাংলা ভাষার নিঃস্বার্থ ও একনিষ্ঠ সেবক বলে অভিহিত করেন এবং বলেন যে এ ভাষা একদিন বিশ্বের যেকোনো ভাষার সমকক্ষ হবে।
রামকমল সেন কীভাবে বাংলা ভাষার একটি অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করেন, তা অতিশয়োক্তি মনে হলেও, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যে একটি পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) চমৎকার ইংরেজি লিখেছেন। সর্বোপরি, তাঁরা যে বাংলা ভাষায় তাঁদের সৃজনশীল প্রতিভার ব্যাপক পরিচয় দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যে রেনেসাঁর বিকাশে সহায়তা করেছিল। মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য এবং রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিতে যেভাবে ঐতিহ্যের পুনর্ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে এ কাব্য দুটিকে বলা যেতে পারে রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। গীতাঞ্জলির ইংরেজি (সং অফারিংস) ভাষ্য প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পরে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথকে যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
যে-প্রাচ্যবিদেরা ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্নিমাণের চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে হোরেস হেম্যান উইলসন অন্যতম। ১৮১৮ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন। সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সোসাইটিকে ইতিহাস গবেষণায় আরও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য তাঁকে নতুন পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে ১৮১৮ সাল থেকে। এ কাজে সমন্বয়ের জন্য উইলসনের বন্ধু রামকমল সেনকে নিয়োগ করা হয়।
উইলসনের একটি কঠিন কাজ ছিল পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে কিংবদন্তীর হাত থেকে রক্ষা করে যতটুকু সম্ভব ঐতিহাসিকতার ওপর দাঁড় করানো। কলকাতায় কর্মরত প্রধান প্রাচ্যবিদ হিসেবে তিনি প্রতিনিয়ত নব-আবিষ্কৃত ঐতিহাসিক তথ্যের যাচাই বাছাই করতেন। যাঁরা শঙ্করাচার্যকে পৌরাণিক কাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, উইলসন ১৮১৯ সালে তাঁর সংস্কৃত ব্যাকরণের ভূমিকায় তাঁদের প্রশংসা করেন। এর আগে ১৮১৩ সালে উইলসন এ দুরূহ কাজটি করেন মহাকবি কালিদাস সম্পর্কে। শঙ্করাচার্যকে ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি একই কাজ করতে চান গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে। তিনি তাঁকে ঐতিহাসিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এবং কিংবদন্তী থেকে মুক্ত করতে চান। উইলসন এবং অন্যান্য প্রাচ্যবিদের চেষ্টায় বুদ্ধদেব দেবতার পরিবর্তে যিশুখ্রিস্টের মতোই একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিতে পরিণত হন।
গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাচীন পান্ডুলিপি আবিষ্কার ছিল উইলসনের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। তিনি ১৮২৫ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত কাশ্মীরের ইতিহাস সংবলিত রাজতরঙ্গিণী সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যা ছিল একজন প্রাচ্যবিদ কর্তৃক অনুপ্রাণিত ভারতবর্ষের প্রথম আঞ্চলিক ইতিহাস। প্রাচীন ভারতের নাটক সম্পর্কে গবেষণা সহ তিনি প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাবিদ্যার একটি সুবিন্যস্ত ইতিহাসও প্রকাশ করেন। ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার পূর্বে পর্যন্ত তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যেরাও ভারতের বহুসংখ্যক মৌলিক ঐতিহাসিক বিবরণ প্রকাশ করেন। এসব কারণে তাঁকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানেই লেখা হয়েছিল নেপাল, উড়িষ্যা, রাজস্থান এবং কাশ্মীরের প্রথম প্রকাশ্য ইতিহাস।
এসব আঞ্চলিক ইতিহাস ছাড়াও প্রাচ্যবিদেরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন প্রাচীন ইতিহাসের দিকে। হয়তো বা এ কারণেই মুসলিম পন্ডিতেরা এশিয়াটিক সোসাইটির কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে চাননি। এমনকি উনিশ শতকের পরেও দীর্ঘকাল এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রধানত বাঙালি হিন্দু বিদ্বজ্জনেরাই। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, শিল্পকলা ও সাহিত্য এবং সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বৈচিত্র্য ও গভীরতা কত বেশি তা অনুধাবন করলে বোঝা যায়, কী কারণে হিন্দুরা তাঁদের পূর্ব পুরুষদের কৃতিত্ব নিয়ে গর্ববোধ করতেন। এ কৃতিত্বকে তাঁরা বস্ত্তত নিজেদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন।
এ উত্তরাধিকারের প্রথম সচেতন ও উদ্যোগী পুরুষ রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩)। তাঁকে বলা যায় বাংলার রেনেসাঁর প্রথম বড় উদ্গাতা। রামমোহনের জন্ম হয়েছিল একটি পুরানো ঐতিহ্যবাহী পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন ক্রয়সূত্রে একজন ক্ষুদ্র জমিদার। রামমোহন রায় ১৭৯৭-১৮০২ সালের মধ্যে প্রথমবারের মতো কলকাতায় বসবাস শুরু করেন বলে ধারণা করা হয়। এ সময়ের মধ্যে রামমোহন প্রধানত লগ্নি কারবারে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি প্রধানত ইংরেজ সিভিলিয়ানদের ঋণ দিতেন। তাঁর সিভিলিয়ান-মুনিব ছিলেন জন ডিগবি। ডিগবি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রথম দিকের (১৮০১-১৮০৩) ছাত্র ছিলেন। তাঁর কাছে রামমোহন রায় ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হন। রামমোহন রায় প্রাচ্যবিদদের অবদানকে আত্মস্থ করেন এবং রপ্ত করেন তাঁদের ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকতা। অপরদিকে তিনি হিন্দু একেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টীয় ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দ্বিমুখী আক্রমণের মোকাবিলায় কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর ১৮১৫ সালে বেদান্তের অনুবাদ প্রকাশ করেন। তিনি এ সময় থেকে হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা নিজস্ব ধারণা তৈরি করেন এবং ইংল্যান্ডে (১৮৩০) যাবার আগে পর্যন্ত এর সপক্ষে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং জনসমক্ষে যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হন। এক্ষেত্রে তাঁকে দ্বিমুখী মতের বিরোধিতা করতে হয়। একদিকে তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের মতের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দেন, অন্যদিকে তাঁর সমাজে ও ধর্মে প্রচলিত কুপ্রথার সংস্কারের জন্য তৎপরতা চালান।
বেদান্তের সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় রামমোহন যুক্তি দেন যে, তখনকার ভারতবর্ষে যে-মূর্তিপূজা প্রচলিত ছিল, তা বৈদিক ধর্মের মূল একেশ্বরবাদ থেকে ভিন্ন। তাঁর মতে, প্রকৃত অনন্ত ঈশ্বরের পূজায় পৌত্তলিকতার কোনো স্থান নেই। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এক্ষেত্রে তাঁকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ভারতের ইতিহাসকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেন। প্রথম ভাগ বেদান্তের কাল, যখন হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে, আইন ও সাহিত্যের প্রামাণ্য প্রকাশ ঘটে; দ্বিতীয় ভাগ মূর্তিপূজার কাল, যখন অসংখ্য দেবদেবী ও তাঁদের মন্দির গড়ে ওঠে। ফলে সমাজ-কাঠামো পরিবর্তিত হয়। রামমোহন যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, বিভ্রান্ত ব্রাহ্মণরা পৌরহিত্য করতে গিয়ে বেদান্তের জ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের নিজেদের ভাষায় তুলে না-ধরে সংস্কৃত ভাষার দুরূহতার মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ কারণে রামমোহন নিজে বেদান্ত এবং অন্যান্য ধ্রুপদী উপকরণ বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, মধ্যযুগে ধ্রুপদী সাহিত্য এবং দর্শনের জ্ঞান লোপ পায় এবং ভারতীয় সমাজ বহু দেবদেবী সংবলিত মূর্তিপূজার অবিশ্বাস্য বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। ১৮১৬ সালে প্রকাশিত উপনিষদের অনুবাদে রামমোহন বলেন যে, প্রকৃত হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম ধর্ম থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন নয়, কারণ এ তিন ধর্ম এক পরমেশ্বরের কথা স্বীকার করে। তিনি বলেন এক পরমেশ্বরের ঈঙ্গিতে বিশ্বব্রহ্মান্ড পরিচালিত হয়।
রেনেসাঁ ও আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে রামমোহন ধর্ম সংস্কার ও সমাজ সংস্কার দুইই করতে ব্রতী হন। বেদের সপক্ষে ১৮১৭ সালে তিনি যে পুস্তিকা প্রকাশ করেন, তাতে তাঁর এ মনোভাব প্রকাশ পায়। এতে তিনি বলেন যে, সতীদাহ প্রথার সপক্ষে শাস্ত্রে কিছু উল্লেখ নেই; তা সত্ত্বেও বিধবাদের সহমরণে বাধ্য করা হয়। তিনি পণপ্রথা, সতীদাহ এবং কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধেও মত প্রকাশ করেন।
বাংলার রেনেসাঁর চতুর্থ বৈশিষ্ট্য, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণায় প্রাচ্যবিদদের সামান্যই অবদান ছিল। এর আবেদন ছিল বিদ্বজ্জনদের সেই অংশের কাছে যাঁরা আদি হিন্দুধর্মকে অন্বেষণ করেন প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল যুগে। কিন্তু উনিশ শতকে হিন্দু কলেজের যে তরুণ ছাত্রদের নিয়ে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তাঁরা ভারতের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির দিকে তাকানো নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। এর পরিবর্তে তাঁরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার সপক্ষে বক্তব্য রাখেন। এ গোষ্ঠীর নেতা হেনরি ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইংরেজির শিক্ষক (১৮২৬-১৮৩১) ছিলেন। সময় হিসেবে এ ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু এরই মধ্যে তিনি অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেন। এ গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়েছেন সমকালীন পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল ধারণা দিয়ে, যাকে তাঁরা ভবিষ্যতের উন্নতিশীল ধারণা বলে গণ্য করেন।
ডিরোজিও ছিলেন ইউরেশীয় এবং তাঁর পিতা ছিলেন পর্তুগীজ। পৃথিবীর সব জাতির ক্ষেত্রে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, এ মতবাদে তিনি রামমোহনের সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে রামমোহনের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক বেশি পাশ্চাত্য-প্রভাবিত। প্রগতির প্রশ্নে ধর্মকে তিনি অন্তরায় মনে করতেন। বিবেকী যুক্তিধারায় তিনি ছিলেন আপোসহীন। অষ্টাদশ শতকের বিশ্ববাদের আদর্শিক ধারণায় তিনি প্রাচ্যবিদ উইলিয়ম জোনস এবং রামমোহনের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করতেন। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী আবিষ্কারের মাধ্যমে উইলিয়ম জোনস ইউরোপ ও এশিয়াকে এক ভাষাসূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। এশীয়দের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের হাতে রিফর্মেশনের পাশ্চাত্য আদর্শের পুনর্ব্যাখ্যাও তার মধ্যে একটি। অপরদিকে রামমোহনের একশ্বেরবাদের বৈশ্বিক ভিত্তিও ছিল উইলিয়ম জোনস পরিকল্পিত চিন্তার সরণীবাহী। একটা অভিন্ন বৈশ্বিক ধারণকে রূপ দেওয়াই ছিল এঁদের প্রত্যেকের লক্ষ্য ও প্রযত্ন।
কলেরায় আক্রান্ত ডিরোজিয়োর মৃত্যু হয় মাত্র বাইশ বছর বয়সে (ডিসেম্বর ১৮৩১)। কিছু সাহিত্যকর্ম থাকলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছেন অষ্টাদশ শতকের নিখুঁত মনুষ্যত্বের ধারণায়। তিনি মনে করতেন সুদূর প্রাচীনকালের আদর্শ এবং মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ভারতের পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। ভারত যাতে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে, তার জন্য ভারতীয়দের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন পশ্চিমের সাংস্কৃতিক অবদান। ছাত্রদের কাছে তিনি বঙ্গীয় রেনেসাঁর এ উত্তরাধিকারই দান করেছেন।
উনিশ শতকের মধ্যপর্বে কলকাতা পরিণত হয় পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে আহরিত প্রাচীন ও আধুনিক জ্ঞানের পাদপীঠরূপে। নানা বিষয়ের নতুন নতুন গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রের নিয়মিত প্রকাশে যে পরিমন্ডল গড়ে ওঠে এবং বিদ্বজ্জনদের মধ্যে বিচিত্র রকম ভাবের আদানপ্রদানে যে একটি অসাধারণ সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়, অনুভবে আর অনুভূতিতে যার প্রকাশ উনিশ শতকের পূর্বে দেখা যায়নি। এসব চিন্তাভাবনার পাশাপাশি পেশাদারদের মধ্যেও একটি সামাজিক অখন্ডতা ও ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে।
এ পেশাদারদের উদ্ভব ঘটে প্রধানত পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে, যাঁরা ছিলেন শিক্ষায় এবং কারিগরি দক্ষতায় বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের দক্ষতা ও পেশাগত পদমর্যাদা স্থানীয়দের অনুপ্রাণিত করে। নতুন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তরা নিজেদের বাড়িতে একটি করে গ্রন্থাগার গড়ে তুলে মুদ্রিত গ্রন্থাদির উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গর্ববোধ করতেন। এভাবে পুরো কলকাতা জুড়ে বইয়ের দোকান বাড়তে থাকে এবং শিক্ষা পরিণত হয় বৈষয়িক উন্নতি ও আকাঙ্ক্ষিত মূল্যবান বস্ত্ততে। এ সামাজিক-মননশীল অভিযাত্রা শুধু কলকাতা বা বঙ্গদেশেই আবদ্ধ থাকেনি, বোম্বাই ও মাদ্রাজের মতো ভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেও ছড়িয়ে পড়ে। [ডেভিড কফ]