বঙ্গবিভাগ, ১৯৪৭

বঙ্গবিভাগ, ১৯৪৭  বাংলার রাজনৈতিক ভূগোলে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন। প্রাচীনকাল থেকে অসংখ্য রাজা ও ভূ-পতি ভারতের পূর্বাঞ্চলকে যে বহুসংখ্যক জনপদে বিভক্ত করে শাসন করে আসছিল হোসেনশাহী শাসন বাংলার সে রাজনৈতিক প্রবণতার অবসান ঘটায়। স্থাপিত হয় সমগ্র বাংলা জুড়ে হোসেনশাহী সাম্রাজ্য। মুগল শাসনামলে ও ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে বাংলার সীমানা মাঝেমধ্যেই পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এসব পরিবর্তন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হবার পূর্ব পর্যন্ত জনগণকে তেমন আলোড়িত করে নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ এমনই অসন্তোষ সৃষ্টি করে যে নিজেদের উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে ব্রিটিশরা অবশেষে ১৯১১ সালে তা রদ করতে বাধ্য হয়।

১৯৪৭ সালে বঙ্গবিভাগ হয়েছিল অনেকটা পূর্বেকার বিভাগ অনুসরণ করেই। তবে ভারত এবং এর সঙ্গে বাংলারও এ বিভাগ হয়েছিল মূলত হিন্দু-মুসলিম জনমত, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এবং জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার পশ্চিমাঞ্চলকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তানে। উল্লেখ্য যে, ১৯০৫ সালের বাংলাবিভাগ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হিন্দু ও মুসলিম জনগণ প্রত্যাখ্যান করলেও কংগ্রেসবিরোধী মুসলমানগণ এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল, বিশেষ করে পূর্ববাংলার জনগণ। পক্ষান্তরে বাংলাবিভাগের পক্ষে হিন্দু মহাসভার প্রস্তাব মেনে নিয়ে হিন্দু জনতা ১৯৪৭ সালের বঙ্গবিভাগকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। মুসলিম নেতৃত্ব প্রথমে এর বিরোধিতা করে, তবে পরবর্তী সময়ে অনিচ্ছাকৃতভাবেই তা মেনে নেয়। হিন্দু ও মুসলিম জনগণের মধ্যে সেসময়কার রাজনৈতিক মনোভাবের পরিবর্তন ছিল মূলত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরই বহিঃপ্রকাশ। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ মুহূর্তে উদ্যোগ নেন বাংলাকে একটি অখন্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। বলা বাহুল্য, তাঁর এ প্রয়াস সফল হয় নি।

১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে বাংলায় যে কয়টি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল তাতে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের প্রাধান্য ছিল। এতে হিন্দু জনগণের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছিল। ফলে হিন্দুদের মধ্যে সংশয় দেখা দেয় যে বাংলা অবিভক্ত থাকলে সেখানে হয়তো সংখ্যাধিক্যের কারণে মুসলমাদেরই আধিপত্য থাকবে। এ কারণে তারা বাংলাকে অখন্ড রেখেই ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখতে আগ্রহী ছিল, বাংলাকে পৃথক বা  পাকিস্তানের অংশরূপে কোনভাবেই মেনে নিতে চায় নি। অপরদিকে মুসলমানদের শঙ্কা ছিল যে, বাংলা অখন্ড ভারতের অঙ্গীভূত হলে এখানে নানা কারণে হিন্দুরাই প্রাধান্য বিস্তার করবে। উভয় সম্প্রদায়ের এসব নেতিবাচক মনোভঙ্গী থেকেই বাংলাবিভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

বাংলাবিভাগের ক্ষতিকর দিক সামলাতে এবং ভারতকে অখন্ড রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৬ সালের মে মাসে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন তিন গ্রুপের অঞ্চল সমন্বয়ে একটি ভারতীয় ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দেয়। তবে ইতোমধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ এমন তীব্র রূপ লাভ করে যে এ পরিকল্পনা আর কার্যকর হয় নি। ১৯৪৭ সালের ২ জুন অনুষ্ঠিত নেতৃবর্গ সম্মেলনে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবিভাগ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন এবং ‘সাত বড় নেতা’ (কংগ্রেসের নেহেরু, প্যাটেল ও কৃপালানী, মুসলিম লীগের জিন্নাহ, লিয়াকত ও আবদুর রব নিশতার এবং শিখ নেতা বলদেব সিং) এ প্রস্তাব মেনে নেন।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন প্রকাশিত বাংলাবিভাগ পরিকল্পনায় বাংলাকে বিভাজনের বিস্তারিত পদক্ষেপ ও কার্যক্রম এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতিসমূহ বিধৃত হয়। এসবের মধ্যে ছিল (ক) বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত ও মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পৃথকভাবে এবং অনুরূপ পাঞ্জাবেও গণভোট অনুষ্ঠান; (খ) আসামের সুরমা অববাহিকায় (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলায়) এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোট অনুষ্ঠান; এবং (গ) প্রস্তাবিত রাজ্য/প্রদেশসমূহের সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাবিভাগের সিদ্ধান্ত গণপরিষদে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন। এরপর কয়েক দফা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ ১২৬-৯০ ভোটে ভারতের গণপরিষদে বিভক্তির সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেন। পক্ষান্তরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচনী এলাকার গণপরিষদ সদস্যরা পৃথক বৈঠকে ১০৬-৩৫ ভোটে বাংলাবিভাগ প্রস্তাব অনুমোদন করেন এবং পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহের গণপরিষদ সদস্যবর্গ ৫৮-২১ ভোটে বাংলাবিভাগের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সিলেটের গণভোটে ২,৩৯,৬১৯ জন সিলেটকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেন। ১,৮৪,০৪১ জন মত দেন এই অঞ্চলকে আসামের মধ্যে রাখতে, অর্থাৎ এই গণভোটে ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে স্থানীয় জনগণ সিলেট এলাকাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে রায় দেন।

১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রণীত ভারতের স্বাধীনতা আইনে বলা হয় যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে।  এতে উল্লেখ ছিল যে, দুটি সার্বভৌম ডোমিনিয়নে ভারত বিভক্ত হবে এবং এ দুটি ডোমিনিয়ন হবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্র ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তান। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি কমিশন ও কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দান করে। এ কমিশনে একজন চেয়ারম্যান এবং ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একজন করে সদস্য নিয়োগের বিধান রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কমিশনের চেয়ারম্যান এককভাবে তড়িঘড়ি করে পনেরো দিনের মধ্যে কাগজে কলমে সীমানা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন করেন।

বাংলাবিভাগের জন্য সীমানা নির্ধারণ কমিশনের প্রধান ছিলেন স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ। তাঁর নেতৃত্বে কমিশন প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় মানচিত্র তৈরি করে। ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭-এর আওতায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের নিকট এবং ১৫ আগস্ট ভারত সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।  [হারুন-অর-রশিদ]