বঙ্গবাজার

বঙ্গবাজার  ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত মূলত তৈরি পোশাক বিক্রয়ের একটি বাজার। এই বাজারে সবধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ ও পোশাক তৈরির কাটা কাপড় সস্তামূল্যে বিক্রয় হয়। এখানে দেশের সকল এলাকার এবং বিদেশেরও অসংখ্য ক্রেতা প্রতিদিন ব্যক্তিগত ব্যবহার বা উপহারের জন্য তৈরি পোশাক কিনতে আসে। খুচরা ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে পাইকারি হারে মালামাল কিনে থাকে। তবে শুরুতে এটি তৈরি পোশাকের বাজার ছিল না। ১৯৬৫ সনে জায়গাটি নানা ধরনের খুচরা পণ্যের হকার ও ছোট দোকানদারদের ব্যবসায় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সে সময় ফুলবাড়িয়ার এই জায়গাটি ছিল ঢাকার প্রধান রেলস্টেশনের একেবারে সংলগ্ন এবং এ কারণে বাজারটিও হালকা খাবার, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও স্যুভেনির বিক্রয়ের একটি আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছিল। বাজার গড়ে ওঠার বছর চারেকের মধ্যেই ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন কমলাপুরে সরিয়ে নেওয়া হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সংযোগস্থল বলে স্থানটির গুরুত্ব আগের মতোই রয়ে যায়। ফলে হকার ও অন্যান্য দোকানদার এই বাজার পরিত্যাগ না করে বরং এখানে স্থায়িভাবে থাকার ব্যবস্থা করে। তাদের অনেকেই আবার অবৈধভাবে অস্থায়ী টিনশেড তৈরি করে।

১৯৭৫ সালে ঢাকার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ সব ধরনের টিনশেড ও অস্থায়ী কাঠামো ভেঙে দিয়ে এখানে একটি পাকা বাজার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জায়গাটির মালিকানা ছাড়তে অস্বীকার করে। এ অবস্থায় দোকানমালিকরা রেল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে বার্ষিক ইজারা চুক্তির ভিত্তিতে খন্ড খন্ড জায়গায় নিজ নিজ দোকান বসানোর অধিকার লাভ করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে সিটি কর্পোরেশন জায়গাটির মালিকানা পায় এবং ১৯৮৯ সালের মধ্যে পরিকল্পিত পাকা বিপণি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করে। নতুনভাবে তৈরি বাজারটির মোট আয়তন ২১,২৫০ বর্গফুট। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ এই পাঁচ বছরেই মূলত বাজারটি তৈরি পোশাকের বাজার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বাজারটি বঙ্গবাজার নামে নিজ পরিচিতি অর্জন করলেও বস্ত্তত এখানে গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ হকার্স মার্কেট নামের অন্য তিনটি সংলগ্ন বাজারের দোকান একত্রে মিশেছে। এদের সীমানা এখন আলাদা করা দুরূহ।

বঙ্গবাজার থেকে অল্পদামে নানারকম তৈরি পোশাক (জামা, প্যান্ট, জ্যাকেট, সোয়েটার, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া ইত্যাদি), পাদুকা সামগ্রী এবং শাড়ি কেনা যায়। এখানে এসব পণ্য খুচরা ও পাইকারি হারে বিক্রয় হয়। বিদেশি ক্রেতা ও তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের যোগান দেওয়া কাঁচামাল ব্যবহারের পর দেশের পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে যত কাপড়, সুতা, বোতাম, জিপার ইত্যাদি উদ্বৃত্ত থাকে মূলত সেগুলি দিয়ে তৈরি বলে বঙ্গবাজারের পোশাক দামে সস্তা। দেশে ট্রেডমার্ক আইন তেমন শক্ত নয় আর ডিজাইন ও সেলাই কৌশল নকলেও স্থানীয় দর্জিরা খুবই দক্ষ বলে বঙ্গবাজারের পোশাক সামগ্রী বিদেশি লেবেলে চালিয়ে দেওয়া হয়। তবে পোশাকগুলি গুণগতভাবেও উন্নত। ঢাকার সিদ্দিক বাজার, তাঁতিবাজার, বাংলাবাজার, বংশাল এবং অন্যান্য এলাকার অনেক স্থানীয় পোশাক প্রস্ত্ততকারী প্রতিষ্ঠানের শো-রুম বা সেলস কাউন্টার হিসেবেও বঙ্গবাজারে অনেক দোকান আছে। মোট ২,২০০ দোকানের জন্য বঙ্গবাজারের পরিসর অপ্রতুল বলে এর ভিতরে দোকানের সারিগুলি অপ্রশস্ত। অনেক সময় ক্রেতার ভিড়ে ভিতরটা হয়ে ওঠে অসহ্য। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা ছাড়াও খুচরা ও পাইকারি ভিত্তিতে পোশাক সামগ্রী কেনার জন্য এখানে আসে ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া, ইরান ইত্যাদি দেশের ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ক্রেতারা। বাংলাদেশে অবস্থিত অনেক দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিদেশিরাও এ বাজারে প্রায় নিয়মিত আসে। এভাবে বঙ্গবাজার দেশের বাইরেও পরিচিতি অর্জন করেছে। প্রতিদিন বঙ্গবাজারে আসা বিদেশি ক্রেতাকে সাহায্য করতে অল্পবয়সী স্বশিক্ষিত অনেক দোভাষীকে বাজারের ভিতর সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। বিদেশি কোন ভাষাতেই এদের তেমন দক্ষতা না থাকলেও দরদাম এবং পোশাক-পরিচ্ছদের নাম, রং ও সাইজ বোঝানোর জন্য দরকারি বিদেশি ভাষায় এরা যথেষ্ট পারদর্শী।

দেশে এবং বিদেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবাজার এমনিতে যে পরিচিত অর্জন করেছিল তা আরও ব্যাপক হয় ১৯৯৫-এর একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে। ঐ বছর এক বিশাল অগ্নিকান্ডে গোটা বাজার ভস্মীভূত হয়ে যায় এবং ঘটনাটি পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে সবিস্তার প্রচারিত হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এরপর বাজারটিকে নতুন করে গড়ে তোলে। এর মধ্যে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স এবং সুন্দরবন কমপ্লেক্স নামে দুটি দশ তলা বাজার ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। পরিকল্পনায় এদের প্রথমটি বঙ্গবাজার এবং দ্বিতীয়টি মহানগরী ও আদর্শ হকার্স মার্কেট-এর দোকানিদের জন্য নির্ধারণ করা আছে। [এস.এম মাহফুজুর রহমান]