ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান
ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান (Flood Action Plan-FAP) বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যার কারণ ও প্রকৃতি নির্ণয় এবং এই বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি রূপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সমীক্ষা। এই সমীক্ষা সংক্ষেপে ফ্যাপ (FAP) নামেই অধিক পরিচিত। পূর্বে পরিচালিত কয়েকটি সমীক্ষাকে ভিত্তি করে ফ্যাপ-এর কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এসকল সমীক্ষা ইউএনডিপি (UNDP), একটি ফরাসী প্রকৌশল কনসোর্টিয়াম, ইউএসএইড (USAID) এবং জাইকা (Japan International Cooperation Agency) কর্তৃক পরিচালিত হয়েছিল। ২৯টি পৃথক উপাদানের সমন্বয়ে ফ্যাপ গঠিত হয়, যাদের মধ্যে ১১টি উপাদান ছিল কয়েকটি পাইলট প্রকল্প সম্বলিত আঞ্চলিক সমীক্ষা এবং অবশিষ্টগুলো ছিল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কিত সমীক্ষা, যেমন: পরিবেশ, মৎস্য সম্পদ, ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা (Geographic Information System) বা জিআইএস, আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা, ভূসংস্থানিক মানচিত্রায়ণ, নদী জরিপ, বন্যা সম্পর্কিত মডেলিং, বন্যা প্রতিরোধ, বন্যা অভিযোজন ইত্যাদি সমীক্ষা। বন্যা সমস্যার স্থায়ী এবং সমন্বিত সমাধানের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির ভিত্তি স্থাপনই ছিল ফ্যাপ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য।
সুদীর্ঘকাল থেকেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি আদর্শ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এদেশে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে বন্যা অন্যতম। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উপকূল থেকে ভূমি অভিমুখে ঘূর্ণিবায়ুর প্রবাহ এবং নদনদীর মাধ্যমে সমুদ্র অভিমুখে অতিরিক্ত পানির প্রবাহের ফলে প্লাবন সমভূমি এলাকাতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় এলাকায় সৃষ্ট বন্যাও মাত্রাভেদে দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অকস্মাৎ সৃষ্ট এই জলোচ্ছ্বাস ব্যাপক আকারে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে থাকে। অন্যদিকে, নদনদীতে সৃষ্ট বন্যাও তার তীব্রতা অনুপাতে দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বাভাবিক প্লাবন বা স্বল্প মাত্রার বন্যা আশীর্বাদস্বরূপ, কেননা এর মাধ্যমে জমিতে উর্বর পলিমাটি ছড়িয়ে পড়ে এবং সেইসঙ্গে জমিতে আর্দ্রতার সংযোগ সাধিত হয়ে থাকে। শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিত উচ্চমাত্রার অস্বাভাবিক প্লাবনই ব্যাপকমাত্রায় জান, মাল ও শস্যের ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করে থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫ এবং ১৮৯২ সালে ছয়টি বৃহৎ বন্যা সংঘটিত হয়। বিংশ শতাব্দীর ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালে সংঘটিত তিনটি ভয়াবহ বন্যা ছাড়াও ১৫টি বড় আকারের বন্যা রেকর্ড করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ১৯০০, ১৯০২, ১৯০৭, ১৯১৮, ১৯২২, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭৪ এবং ১৯৮৪ সালে সংঘটিত বন্যা।
১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালে পর পর বন্যা সংঘটিত হওয়ার পর বন্যা সম্পর্কিত কয়েকটি সমীক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং তখন থেকেই পানি উন্নয়ন খাতে বিশেষ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হওয়ার পর একটি বহুমাত্রিক বন্যা সমীক্ষা কার্যক্রম - ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান (ফ্যাপ) গ্রহণ করা হয় যা ছিল ইউএনডিপি পরিচালিত ফ্লাড পলিসি স্টাডি-এর ধারাবাহিক সমীক্ষা। বিগত ১০০ বছরের তুলনায় ১৯৮৮ সালের বন্যার মাত্রা অধিকতর হওয়ায় ফ্যাপ কার্যক্রম দাতাদের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়।
বন্যা সমীক্ষা কার্যক্রম (Flood studies) ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার পর বাংলাদেশ সরকার বন্যা নীতি এবং বন্যা প্রতিরোধ কর্মসূচিসমূহ সমন্বিত পর্যালোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর পরই বন্যা নীতি সমীক্ষা এবং বন্যা প্রস্ত্ততি সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এ দুটি সমীক্ষা কার্যক্রমই ইউএনডিপি (UNDP)-এর সহায়তায় স্থানীয় এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা গঠিত টিম কর্তৃক পরিচালিত হয় এবং ১৯৮৯ সালের শুরুর দিকে সমাপ্ত হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য নিয়ে গঠিত একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বন্যা নীতি সমীক্ষা কার্যক্রমের সুপারিশমালা চূড়ান্ত করা হয়। একই সময়ে আরও তিনটি সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এগুলো ছিল ফরাসী সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত Pre-feasibility Study of Flood Control in Bangladesh; ইউএসএইড-এর সৌজন্যে পরিচালিত Eastern Waters Study; এবং জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত Report on Survey of Flood Control Planning in Bangladesh।
ইতোমধ্যে ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জি-৭ শীর্ষবৈঠকে বাংলাদেশে পুনঃপুনঃ সংঘটিত বন্যার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে নোট গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বন্যা সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন বৈদেশিক আগ্রহকে সমন্বয় সাধন করার জন্য সরকার বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানায়। জি-৭ শীর্ষবৈঠকে বাংলাদেশের বন্যা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সে অনুসারে বিশ্বব্যাংক বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা প্রণয়ন কার্যক্রম গ্রহণে সমন্বয় সাধন করে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর পরিচালিত সমীক্ষাসমূহ থেকে সরকার দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অন্যতম উপাদান হিসেবে কাঠামোগত প্রতিরোধ কার্যক্রম নীতি গ্রহণ করে এবং বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ছয়টি মূলনীতি অনুসরণ করে। ভবিষ্যতে সকল প্রকার পরিকল্পনা প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে সরকার এগারোটি নির্দেশনামূলক মূলনীতিও প্রণয়ন করে।
ফ্যাপের এগারোটি নির্দেশনামূলক মূলনীতি (১) গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষা এবং কৃষি, মৎস্য, নৌচলাচল, নগর বিধৌতকরণ এবং ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ জলাধারের পুনর্নবায়নের লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত বন্যা সংঘটনের উদ্দেশ্যে পর্যায়ক্রমে সমন্বিত প্লাবনভূমি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা; (২) বন্যা সুরক্ষিত ও অরক্ষিত উভয় এলাকায় কার্যকর ভূমি ও পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা; (৩) বন্যা প্রস্ত্ততি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি জোরদার করা; (৪) বন্যা পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো; (৫) প্রধান প্রধান নদনদীর উভয় তীরের ভেড়িবাঁধের সাহায্যে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা বিপুল জলরাশির নদীখাতের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে নিরাপদ প্রবাহ নিশ্চিত করা; (৬) ভেড়িবাঁধ এবং নগর কেন্দ্রসমূহ সুরক্ষার জন্য নদীশাসন করা; (৭) প্রধান প্রধান নদীর প্লাবনমাত্রা হ্রাস করার লক্ষ্যে শাখানদী এবং বন্যা উপশমকারী নদীখাতের (flood relief channels) মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত প্রবাহের গতি পরিবর্তন করা; (৮) সুষ্ঠু নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নদীখাত উন্নয়ন ও কাঠামো নির্মাণ; (৯) যেখানে যেখানে সম্ভব এবং যথার্থ সেসকল অঞ্চলে প্লাবনভূমিসমূহকে জোনে বিভক্তকরণ; (১০) পানির চলাচলকে ব্যাহত না করে সকল প্রকার গ্রামীণ রাস্তাঘাট, মহাসড়ক ও রেলপথভিত্তিক ভেড়িবাঁধ নির্মাণের বেলায় সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং (১১) বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন কর্মকান্ডের পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তাদের সমর্থন সংগ্রহ করা। [এম আমিনুল ইসলাম]