ফ্রান্সিস, স্যার ফিলিপ
ফ্রান্সিস, স্যার ফিলিপ (১৭৪০-১৮১৮) ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের অধীনে সৃষ্ট বাংলার ফোর্ট উইলিয়ম সরকার পরিষদের (কাউন্সিল) চারজন সদস্যের অন্যতম। তিনিই বাংলা প্রদেশের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনাকারী ছিলেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড হেসটিংস এর সঙ্গে তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এবং তিনি হেসটিংস-এর বিরুদ্ধে সংসদীয় বিচার বিতর্কে অংশগ্রহণকারী ব্রিটেনের সংসদীয় নেতা এডমান্ড বার্ক, ফক্স ও স্যারিডন এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের বন্ধু ছিলেন।
ফিলিপ ফ্রান্সিস ১৭৪০ সালের ২২ অক্টোবর ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন। লন্ডনের সেন্ট পল স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন এবং সেখানে তিনি প্রাচীন চিরায়ত সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৭৬১ সালে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পিট দ্যা এলডারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিশনের ব্যক্তিগত দূত হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করেন। ফ্রান্সিস তাঁর সমসাময়িকদের দ্বারা পাবলিক এডভারটাইজারে ১৭৬৯ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত শ্লেষাত্মক চিঠি লেটার অব জুনিয়াস লিখার জন্য দায়ী লেখক হিসেবে সন্দেহ ভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন। কারণ এ চিঠিসমূহের মাধ্যমে তৎকালীন প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের দূর্বলতাসমূহ প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। পরবর্তিকালে লেটার অব জুনিয়াস এর কম্পিউটার বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, আদতে ঐ চিঠি সমূহের লেখক ফ্রান্সিসই ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী পিট দ্যা এলডার্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম এর সরকার পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের সদস্য পদে আসীন হতে পেরেছিলেন। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট-এর অধীনে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেসটিংস এবং অপর চারজন কাউন্সিল সদস্য (ফিলিপ ফ্রান্সিসসহ) একসঙ্গে বাংলায় ফোর্ট উইলিয়ম এ সুপ্রিম সরকার গঠন করেন। শীঘ্রই প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিভিন্ন অসামঞ্জস্য ধরণ ও অন্যান্য নীতিসমূহ এমনকি কিছু ব্যক্তিগত বিষয়কে সামনে নিয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিস গভর্নর জেনারেলের ওয়ারেন হেসটিংস এর ভূমিকার বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলের চার সদস্যের মধ্যে মনসুন ও ক্লিভারিং ফ্রান্সিসকে সমর্থন করেন এবং হেসটিংস কেবলমাত্র বারওয়েলের সমর্থন লাভ করেন।তাঁদের উভয়ের সম্পর্ক এমন বিদ্বেষপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে যে শেষ পর্যন্ত তা পিস্তল হাতে সামনাসামনি দ্বন্দ্বের রূপ ধারণ করে। এ দ্বন্দ্বে ফ্রান্সিস গুরুতর আহত হন এবং ১৭৮১ সালে বাংলা ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে ফিরে যান।
১৭৮৪ সালে ফ্রান্সিস উইট এর দ্বীপাঞ্চল ইয়ার মাউথ থেকে হাউজ অব কমন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হন। এ পর্যায়ে এসে তিনি গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে ওয়ারেন হেসটিংসকে সরিয়ে সে স্থলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নিজ ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেন। বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের পর একজন পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি হেসটিংস কর্তৃক কলকাতায় অসৌজন্যমূলক আচরণের দায় এনে পার্লামেন্টে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ (ইমপিচমেন্ট) উত্থাপন করেন। এই উদ্যোগে তিনি এডমান্ড বার্ক, সি,জে ফক্স এবং সেরিডান নামক তাঁর তিন সংসদীয় প্রভাবশালী বন্ধুর সমর্থন লাভ করেন। ওয়ারেন হেসটিংস-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসাদাচরণের জন্য তাঁরা বিশটি অভিযোগ দায়ের করেন এবং এ বিচারকার্য ১৭৮৫ থেকে ১৭৯৫ সালের শেষপর্যায় পর্যন্ত চলে। কিন্তু রায়ে হেসটিংসকে ঐ সকল দায় থেকে নির্দোষ বলে অব্যহতি দেয়া হয়। এই রায় ফ্রান্সিস-এর ভাবমূর্তি নষ্ট করে এবং হেসটিংস-এর স্থানে নিজেকে ভারতের গভর্নর জেনারেল এর পদে দেখার যে স্বপ্ন তাঁর ছিলো, তা বিফলে যায়। যদিও এই দীর্ঘমেয়াদী বিচারকার্য পরিচালনার জন্য হেসটিংসকে যে ব্যয়ভার বহন করতে হয় তা তাকে সর্বস্বান্ত করে দেয় (ফ্রান্সিসের ভাষায়, ভারত থেকে লুণ্ঠিত অর্থই শেষ হয়েছিলো)।
স্বল্প সময়ের ও সুখকর না হলেও ভারতে ফিলিপ ফ্রান্সিসের কর্মকালে তিনি বাংলার উন্নয়নে নিজের জন্য একটি স্থায়ী আসন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। গভর্নর জেনারেল পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি প্রথম ১৭৭৬ সালে বাংলার রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধারণা ব্যক্ত করেন। ফ্রান্সিস যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, বাংলার ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক অবস্থা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তার জন্য তিনি ১৭৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ‘ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্তের পরিকল্পনা’ উপস্থাপন করেন। তাঁর এ পরিকল্পনা প্রথম টমাস ল’ বিহার প্রদেশের রাজস্ব সংক্রান্ত কাজ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গ্রহণ করেন। ১৭৮৯-৯০ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ এ পরিকল্পনা আপাতত গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর ‘দশশালা বন্দোবস্তে’র অবসান ঘোষণা করেন এ মর্মে যে, যদি দশ বছরের ভূমি ব্যবস্থাপনায় আশাতীত ফল অর্জিত হয়, তবে সেই বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তর করা হবে যা ১৭৯৩ সালের আইনের আওতায় ‘আইন- ১, ১৯৭৩’ (Act 1, 1793) নামে সম্পন্ন হয়েছিলো।
এ পরিকল্পনানুসারে বাংলায় জমির উপর স্বত্ত্বআরোপকারী একটি স্থায়ী জমিদার শ্রেণির জন্ম হয়। ফিলিপ ফ্রান্সিস এক্ষেত্রে ফরাসি ফিজিওক্র্যাটিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি কখনোই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক অর্থনীতির ধারা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, তাই জানতেন না যে, পশ্চিমা ভূমি ব্যবস্থার পদ্ধতি সমূহ বাংলার ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কার্যকর করা কখনোই সম্ভব না। কারণ এখানে ভূমির মালিকানা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো, কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে হতো না। সে সময়ে বাংলার সামাজিক কাঠামোতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণা অনুপস্থিত ছিল। কাজেই কৃষক শ্রেণির অবস্থান পরিবর্তনের পথ হিসেবে জমিদারি প্রথা অকৃতকার্য পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়। কৃষকদের নিকট বংশানুক্রমিক ধারায় প্রাপ্ত সম্পদের উপর তাদের জীবনের প্রতিরক্ষা ও শান্তি নির্ভর করে, জমিদারদের বা তালুকদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর না। তাই বাংলার ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ফিলিপ ফ্রান্সিককেই তার অধিকাংশ দায়ভার স্বীকার করতে হবে।
১৮০৭ সালে ফ্রান্সিস সংসদীয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৮১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [সিরাজুল ইসলাম]
গ্রন্থপঞ্জি Ranajit Guha, A Rule of Property for Bengal: An Essay on the Idia of Permanent Settlement, (Paris 1963); W.K. Firminger, The Fifth Report....on the Affairs of the East India Company 1812-13, (Calcutta 1917); Sirajul Islam, The Permanent Settlement in Bengal: A Study of its Operation 1790-1819, (Bangla Academy 1979).