ফেই সিন
ফেই সিন অ্যাডমিরাল জেং হি’র (খোজা) ভারত মহাসাগর অভিযাত্রায় তিন প্রধান সফরসঙ্গীর মধ্যে একজন। তাঁর নামের সঠিক উচ্চারণ সম্ভবত ফেই জিন। পনেরো শতকের বাংলার দরবারের ওপর লেখা তাঁর বিবরণ মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
ফেই সিন ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে চীনের সুঝৌ এলাকার কুনসান জেলার একটি সাধারণ পন্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ২১ বছর বয়সে ১৪০৯-১১ খ্রিস্টাব্দে জেং হি’র তৃতীয় অভিযানের সময় তিনি সামরিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর সফরসঙ্গী মনোনীত হন। তিনি আরও তিনটি অভিযানে সহযাত্রী হয়েছিলেন, এগুলি হলো ইয়াং মিন-এর সঙ্গে (১৪১১-১৪১৪ খ্রি.) একবার এবং জেং হি’ র পঞ্চম (১৪১৭-১৪১৯ খ্রি.) ও সপ্তম (১৪৩১-১৪৩৩ খ্রি.) অভিযানে সহযাত্রী হন।
১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের (চৈনিকদের কাছে পশ্চিম মহাসাগর) বিভিন্ন দেশ ও সেখানকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ লেখেন। গ্রন্থটির নাম জিংগোচা সেংলান (দি ওভারঅল সার্ভে অফ দি স্টার র্যাফ্ট)। রাজপ্রতিনিধির জাহাজের নাম ছিল ‘স্টার র্যাফট’। গ্রন্থটি প্রথম কবে ছাপা হয় সে সম্বদ্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তবে এর সর্বপ্রাচীন সংস্করণটি ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়।
ফেই সিনের ভ্রমণপঞ্জি মা-হুয়ান এর ভ্রমণপঞ্জির তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কিন্তু তারপরও ঐ অল্প পরিসরেই তিনি পঁয়তাল্লিশটি অঞ্চলের তথ্য সরবরাহ করেছেন। অথচ মা-হুয়ান বর্ণনা দিয়েছেন মাত্র একুশটি দেশের। এরমধ্যে উনিশটি অঞ্চল দুজনের বর্ণনাতেই স্থান পেয়েছে। ফেই সিন বাড়তি যে ছাবিবশটি স্থানের বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলি মা-হুয়ানের গ্রন্থে স্থান পায় নি। অন্যদিকে মা-হুয়ান যে বাড়তি দুটি স্থানের বর্ণনা করেছেন সেগুলি আবার ফেই সিনের গ্রন্থে স্থান পায় নি। শ্রুতিনির্ভর হলেও ফেই সিন’ই প্রথম মধ্যযুগীয় লেখক যিনি আরবের লা’সা (সম্ভবত মাসকট অথবা বীর আলী’র নিকটবর্তী, ১৮.১৯° পূর্ব দ্রাঘিমা) এবং পূর্ব আফ্রিকার মোগাদিসু, ব্রাভা ও গিয়ামবো-এর তথ্য সরবরাহ করেছেন।
তাঁর গ্রন্থটি স্বল্পপরিসরের হলেও, বিভিন্ন বিষয়ে মা-হুয়ানের গ্রন্থের পরিপূরক। ফেই সিন বর্ণনা করেছেন যে, শ্রীলংকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়; রাজা অলগক্কোনর পরাজিত ও বন্দি হন এবং বাংলায় চৈনিক অভিযাত্রীদলে সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। চট্রগ্রামের শুল্ক বিভাগের অফিসে তাদেরকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করা হয় এবং বাংলার উদার সুলতান তাঁর সমৃদ্ধিশালী রাজধানী পান্ডুয়ার রাজদরবারে তাঁদের বিলাসবহুল বিনোদনের ব্যবস্থা করেন।
ফেই সিন ও মা-হুয়ানের বর্ণনায় বেশ কিছু অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। যেমন- ফেই সিন বলেছেন, ফণরং (পান্ডুরঙ্গ) ও চম্পা (মধ্য ভিয়েতনাম) দুটি ভিন্ন দেশ, অন্যদিকে মা-হুয়ান ফণরংকে চম্পার একটি অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আবার ফেই সিন বলেছেন যে, চৈনিক দশ মাসে চম্পার এক বছর হয়, যদিও মা-হুয়ান এ সংখ্যাটি উল্লেখ করেছেন বারো বলে। মা-হুয়ান ভারতে একটি মাত্র কুইলন-এর (কোল্লম), অর্থাৎ ছোট গেলান (জিয়াও জিলান), বর্ণনা দিয়েছেন, অপর পক্ষে ফেই সিন কুইলন ও কেইন কোলান, যা তাঁর কাছে বড় গেলান, উভয়েরই বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলা প্রসঙ্গে তিনিই প্রথম চৈনিক ভ্রমণকারী যিনি পান্ডুয়াকে এর রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর ভারত-চীন বাণিজ্যের ছাত্রের জন্য ফেই সিন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি প্রদান করেছেন, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য এবং লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে চীনের রেশম বস্ত্র, চীনা মাটির সামগ্রী, স্বর্ণ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি প্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন। পনেরো শতকে দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে জানার জন্য ফেই সিন ও মা-হুয়ান একে অপরের পরিপূরক। [হরপ্রসাদ রায়]