ফয়জননেসা, নুরুননাহার
ফয়জননেসা, নুরুননাহার (১৯৩২-২০০৪) শিক্ষাবিদ, গবেষক ও নারী আন্দোলনের নেত্রী। ১৯৩২ সালের ২১ মে নদীয়া জেলার চাকদা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা খান সাহেব কাজী সদরুল ওলা ছিলেন বঙ্গীয় আইনসভায় সহকারি সচিব এবং মাতা বেগম রেতুবননেসা মুর্শিদাবাদের জমিদার পরিবারের মেয়ে। তাঁর পূর্বপুরুষ মির্যা এহতেশাম উদ্দিন এক সময় ছিলেন ব্রিটিশ রাজদরবারে মোগল সম্রাটের প্রতিনিধি (১৭৬৬-১৭৬৮)।
নুরুননাহার ফয়জননেসার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে। ১৯৪৬ সালে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি লেডী ব্রাবোর্ন কলেজে কিছুকাল পড়াশুনা করেন। দেশ বিভাগের পর তাঁর পরিবার চট্টগ্রামে চলে আসে। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই.এ (১৯৪৮) ও বি.এ (১৯৫০) পাশ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি সৈয়দ মকসুদ আলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফয়জননেসা ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার কলোরেডো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন।
বাল্যকাল থেকেই নুরুননাহার ফয়জননেসা উদার পারিবারিক পরিবেশে সংস্কৃতি চর্চা ও ক্রীড়াচর্চার অবাধ সুযোগ পেয়েছেন। আট নয় বছর বয়সেই তিনি ‘মুকুল মেলা’র সদস্য হন এবং কৈশোরেই কেন্দ্রীয় মুকুল মেলা (বোন বিভাগ) পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তাঁরই উদ্যোগে ১৯৪৪ সালের ৩ জুলাই কলকাতার ইসলামিয়া ক্লাব গ্রাউন্ডে ‘সিরাজ দিবস’ পালিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ফয়জননেসা রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি নাটকে অভিনয় করেছেন। পরে তিনি ‘মহিলা মাহফিল’ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। তিনি প্রায় একযুগ ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
পেশাগত জীবনে ফয়জননেসা প্রথম সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন (১৯৫৩)। পরে ভিকারুন্নেসা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলে ১৯৬০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আই.ই.আর) অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন। ফয়জননেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রভোস্ট (১৯৮১-৯০) ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য এবং ১৯৮৫-৮৬ সালে সিন্ডিকেটে প্রথম নির্বাচিত মহিলা সদস্য ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারের বোর্ড অব গভর্নসের সদস্য হন। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের বেতন কমিশনের সদস্য ছিলেন এবং ঐ বছরই বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন কেন্দ্রের গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হন।
ফয়জননেসা প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই নারী গবেষণা সংগঠন ‘উইমেন ফর উইমেন’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি এই সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ (১৯৮০-৮১) এবং সহ-সভানেত্রীর (১৯৮৩-৮৫) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘উষা’র নির্বাহী কমিটির সভানেত্রী এবং মহিলা পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভানেত্রী ছিলেন।
নুরুননাহার ফয়জননেসা বহু সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি আজিমপুর লেডিজ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই ক্লাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন অগ্রণী স্কুল। তিনি ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য ‘ছায়ানীড়’ নামে ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছিল মহিলা সমবায় বিপনী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে শহীদ স্মৃতি বেদী স্থাপন করেন। রোকেয়া হলে বেগম রোকেয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নুরুননাহার ফয়জননেসা। তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল এলামনাই এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং এই সংগঠনের প্রথম সভানেত্রী। ফয়জননেসা ছিলেন বেগম রোকেয়া ‘প্রবীন আবাস’সহ বহু সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উইমেন স্টাডিজ’ বিভাগের প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর অবদান ছিল।
ফয়জননেসার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হাতের লেখা শিক্ষণ পদ্ধতি, একাত্তরের প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছদ (সম্পাদনা), কালের সমুখ ভেলা (সম্পাদনা), Children’s World of Affective Behaviour, Social and Political. নুরুননাহার ফয়জননেসা ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [বিলকিস রহমান]