প্রাচ্যবিদ্যা

প্রাচ্যবিদ্যা  ১৭৮৪ সনে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা থেকে প্রথম আবিস্কৃত হয় যে, সুদূর অতীতে ভারত তথা এশিয়ায় উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং অনেক দিক থেকেই এ সভ্যতা ছিল বিশ্ব সভ্যতার অগ্রজ এবং  চমকপ্রদ। এ সভ্যতাকে কেন্দ্র করে আঠারো শতকের শেষ পাদে এবং উনিশ শতকের প্রথম পাদে কলকাতা ও ইউরোপে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। এ প্রচেষ্টায় প্রাথমিক নেতৃত্ব দেন স্যার উইলিয়ম জোনস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি। প্রথম থেকেই প্রাচ্য বিষয়ক সভ্যতা চর্চার নাম দেয়া হয় Orientalism বা প্রাচ্যচর্চা। তাছাড়া বিশ্বপ্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের তুলনামূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনকেও বলা হয় প্রাচ্যবিদ্যা বা প্রাচ্যচর্চা। ১৮৩০-এর দশকে orientalism অভিধাটি প্রথম ফ্রান্সে প্রচলিত হয়। এরপর থেকেই প্রাচ্যবিষয়ক জ্ঞান ও পান্ডিত্যকে বিশেষায়িত করতে এক ধারার রোমান্টিক কল্পনাময় সাহিত্যকর্ম, ভাষা, ইতিহাস, স্থাপত্য, শিল্পকলাকেও বোঝানো হয় এবং এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রাচ্যসম্পর্কিত এক ধরনের আদর্শিক উপলব্ধির প্রতিনিধিত্ব করানোর জন্যও এই প্রাচ্যচর্চা ও বিদ্যাকে কাজে লাগানো হয়। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচ্যবিদ্যা কেন্দ্র।

প্রাচ্যচর্চার জনক ছিলেন, কলকাতা সুপ্রিম কোর্টএর অন্যতম বিচারক স্যার উইলিয়ম জোন্স (১৭৪৬-১৭৯৪)। তিনি ভারতের ধ্রুপদী ভাষাগুলির বিজ্ঞানসম্মত চর্চার সূত্রপাত করেন। তাঁর এ মহতি প্রয়াসে তাঁর সাথে যোগ দেন ভারতীয় ভাষাবিশারদ ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড, চার্লস উইলকিনস, হেনরী টি কোলব্রুক প্রমুখ। তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি। ১৭৮৪ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠিত হয়। উইলিয়ম জোনস আবিষ্কার করেন যে, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বিবর্তনগত ধারায় ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ভাষাগুলির যোগসূত্র রয়েছে। তাঁর এ আবিষ্কার ইউরোপের ধ্রুপদী ও রোমান্টিক বিদ্ব্যৎজনকে রীতিমতো চমৎকৃত করে। তাঁরা এ আবিষ্কারের পথ ধরে মানবজাতির সকল ভাষা নিয়ে নতুন গবেষণামূলক অনুসন্ধান ও সমীক্ষায় নিয়োজিত হন। তাঁদের এসব গবেষণা ও অনুসন্ধানের মূলে যে অনুমান কাজ করে তা হলো, হয়তবা সকল মানুষের ভাষাই পরস্পর সম্পর্কিত। বস্ত্তত, তখন থেকেই ভাষাতত্ত্ব ও (উনিশ শতকের) তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের আদি উৎপত্তি বা সূচনা পর্ব।

উইলিয়ম জোনস ও তাঁর সহযোগীগণ তাঁদের প্রয়াসের গোড়ার দিকে ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চার বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে অনুপ্রাণিত করেন। ১৮২০-এর দশক নাগাদ দেখা যায়, কোম্পানিতে বেশ একদল বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা রয়েছেন যাঁরা ভারতীয় সভ্যতার সমীক্ষায় নিষ্ঠাবান। এ সব বিজ্ঞ ব্যক্তির মধ্যে সবিশেষ উল্লেখের দাবিদার হলেন: উইলিয়ম কেরি, জে.এইচ হ্যারিংটন, এইচ.এইচ উইলসন, ডব্লিউ.বি বেলি, হোল্ড ম্যাকেঞ্জি, ডব্লিউ.এইচ ম্যাকনটেন, জর্জ সুইন্টন, টমাস ফোর্টেস্ক এবং এইচ.টি প্রিন্সেপ ও জেমস প্রিন্সেপ

উইলিয়ম জোনস ও তাঁর সহযোগীগণ আঠারো শতকের ইউরোপীয় চেতনার আলোকে তাঁদের গবেষণা ও সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তাঁদের এ জ্ঞানচর্চা আন্তঃজাতিগত সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কবাদ সম্পর্কে ধারণা দেয়। আলোকিত দার্শনিকদের মতো তাঁরাও বিশ্বাস করতেন যে, মানবজাতির মধ্যে পরস্পর সম্পর্কিত নানা সংস্কৃতি বিদ্যমান আছে। এগুলির সম্পর্কে গবেষণার প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে মানব সভ্যতার স্বার্থে সহনশীলতাও আবশ্যক। নানা সংস্কৃতির বিশ্বজনীনতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘প্রাচ্যবাদী’ কর্মচারীরা ভারতের অতীত ও ঐতিহ্য আবিষ্কারে ব্রতী হন। এ দার্শনিকগণ ভীষণভাবে উপলব্ধি করেন যে, অখন্ড সত্ত্বা, মানবজাতির এককত্বের লক্ষ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং প্রকৃতির সাথে সমতা রক্ষাকল্পে সন্দর্শনের জন্য জ্ঞানালোকের পুনরুজ্জীবন হওয়া দরকার। তারা পাশ্চাত্য পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া ধর্ম, দর্শন ও শিল্পকলারও পুনরায় সমন্বয় সাধনের কথা চিন্তা করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব পর্যন্ত ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের মন জুড়ে ছিল বেদান্তের অদ্বৈতবাদী ও ভাববাদী দর্শন। কিন্তু এ বিপ্লবকে কেন্দ্র করে সংঘটিত আতঙ্ককর ঘটনাবলি প্রাচ্যবিশারদদের মনে, যারা এতদিন ভারতবাসীর শান্ত ও উদাসীন প্রকৃতির উপর জোর দিচ্ছিলেন, দারুণ প্রভাব ফেলেছিল।

উনিশ শতকে, এক নতুন শ্রেণীর প্রাচ্যবিদের আবির্ভাব ঘটে। ভারত ও ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারি তথা ধর্ম প্রচারকেরাও ভারতের অতীত ও বর্তমান নিয়ে গভীর গবেষণা করছিলেন কিন্তু তাঁদের এসব প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। মিশনারি প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের দর্শনে ভারতীয় সভ্যতার দুর্বলতাগুলি খ্রীস্টধর্মের স্বার্থে উন্মোচন করা। একদা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলা ও পরবর্তীকালে চেয়ারম্যান চার্লস গ্র্যান্ট ছিলেন মিশনারি গোষ্ঠীর প্রাচ্যবিদদের নেতা। আলোকিত যুগের যুক্তিবাদী ও রোমান্টিক মানসের জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নেয় এক সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব। আর এ মানসিকতায় এমন ধারণা গড়ে উঠতে থাকে যে, প্রাচ্য দেশিয় সভ্যতা পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় গলদপূর্ণ ও নিকৃষ্ট। এ জাত্যাভিমানী ধারণার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিশ শতকের নব্য প্রাচ্যবাদিগণ জ্ঞানালোকবাদী প্রাচ্যবিদদের বক্তব্যের পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। তাঁদের মতে, প্রাচ্যচর্চা নিছক ‘কিছু আদর্শিক কল্পকথামূলক ব্যবস্থামাত্র’। সাম্রাজ্যবাদী প্রাচ্যচর্চার উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্যের ওপর পাশ্চাত্য শক্তির আধিপত্যকে নৈতিক বাধ্যবাধকতার যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা। পাশ্চাত্য জগতে প্রাচ্যচর্চার এখন দুটি দিক বিদ্যমান। একটি রাজনৈতিক অন্যটি দার্শনিক ও জ্ঞানচর্চামূলক। শেষোক্ত ধারার প্রাচ্যবিদদের প্রায় সকলেই জ্ঞানচর্চার পরিমন্ডলভুক্ত ব্যক্তিত্ব। তাঁদের যুক্তি হলো প্রাচ্যচর্চা জাতিবিদ্বেষবাদের কোন মুখোশ হতে পারে না যা ‘সাম্রাজ্যবাদী’ প্রাচ্যবিদগণ সাধারণত মনে করে থাকেন; বরং প্রাচ্যচর্চা গোটা মানবজাতির অস্তিত্বের একক হিসেবে উপলব্ধি করার বিষয়। অবশ্য, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সকল ধরনের প্রাচ্যচর্চাই পাশ্চাত্য মানুষদেরই গড়া। এর উদ্দেশ্য ও নিষ্ঠা সময়ান্তরে পরিবর্তিত হয়েছে।  [সিরাজুল ইসলাম]