প্রশাসনে বেসরকারি উদ্যোগ
প্রশাসনে বেসরকারি উদ্যোগ সাধারণ জনগণ কর্তৃক স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে সেবামূলক ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা বা প্রকল্প বাস্তবায়ন। এ জাতীয় উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদী বা সাময়িক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গৃহীত হতে পারে। তবে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তিগত বা জনগোষ্ঠীর যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত এ জাতীয় উদ্যোগ সমাজের অন্যান্যদের অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখলে বা তাদের জন্য ক্ষতিকর হলে তা প্রশাসনে বেসরকারি উদ্যোগ বলে গণ্য হয় না। অনেকেই ভুল করে বেসরকারি উদ্যোগ এবং সুশীল সমাজকে সীমিত এনজিও কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করে ফেলেন। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে যখন কোনো কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ছিল না বা থাকলেও তা ছিল অঙ্কুর পর্যায়ে তখন স্বেচ্ছাসেবাভিত্তিক কর্মকান্ড ব্যাপকভাবেই পরিচালিত হতো। আধুনিককালে এধরনের কার্যক্রমকে এক ধরনের বাড়তি কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় যা বাহ্যত সরকারি সংস্থা, স্থানীয় সরকার ও এনজিওগুলোর সহায়তা নিয়ে বা এসব সংস্থার ভেতর ও বাইরে থেকে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশে প্রশাসন পরিচালনায় বেসরকারি বা সামাজিক উদ্যোগের বিভিন্ন ধরন প্রচলিত রয়েছে। সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত প্রশাসন ও সেবামূলক উদ্যোগ কমে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এখনও বিদ্যমান এ জাতীয় কার্যক্রমের অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেমন: সড়ক প্রশস্তকরণ; ঋণ ও সঞ্চয়ী সমিতি পরিচালনা; ময়লা নিষ্কাশন; আবাসন সমিতি এবং যৌথ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা; মসজিদ, কবরস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঠাগার, ক্লাব, হাট-বাজার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা; বৃক্ষরোপন; কচুরিপানা পরিস্কার; খেলাধুলা; সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড; মৃতদেহ দাফন; মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান; সালিশ; মাদকাশক্তি, জুলুমবাজি ও গুন্ডামির বিরুদ্ধে সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ; যানবাহন চলাচল সুগম করা; ওয়াসা ও ডেসাসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা কর্তৃক সেবা প্রদানে অবহেলা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা; প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও আপতকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবামূলক তৎপরতা; ছোটখাট বন্যা মোকাবেলা; এবং সেচকার্য।
বেসরকারি উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর। যেমন, (ক) যেখানে গ্রামীণ সমাজের সালিশের মতো ঐতিহ্যময় ব্যবস্থা চালু আছে; (খ) যেসকল স্থানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসন ভেঙ্গে পড়েছে বা দুর্বল অথবা যেখানে পুলিশ বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ; (গ) দুর্গম সকল স্থানে, যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় এলাকায় বা বঙ্গোপসাগরের প্রত্যন্ত দ্বীপগুলিতে, যেখানে আনুষ্ঠানিক প্রশাসন পৌঁছতেই পারে না; (ঘ) যুদ্ধ, বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড়, মহামারি, নদীভাঙ্গন, ভূমিকম্প, ব্যাপক অগ্নিকান্ড, প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা শরণার্থী সমাগমের মতো জরুরি অবস্থার সময়; (ঙ) যেখানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ বেসরকারি উদ্যোগ বিকাশে বিশেষ উৎসাহ দেয় এবং বিশেষত যেখানে প্রশাসনের ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি সহযোগিতা বেশ কার্যকর; (চ) যেসব স্থানে এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে অনেকটা অজ্ঞাতেই বেসরকারি প্রশাসনিক উদ্যোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে; (ছ) যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার ও বেসরকারি দুধরনেরই প্রশাসন ব্যবস্থা পাশাপাশি চালু আছে এবং এ দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র তত স্পষ্ট নয়; (জ) যেখানে জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে ও সংরক্ষণে বেসরকারি বা গোষ্ঠী উদ্যোগ সরকারের আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনা করে; এবং (ঞ) যেখানে ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর বেসরকারি প্রশাসনিক উদ্যোগ সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করে বা অগ্রনী ভূমিকায় কাজ করে।
প্রশাসনে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উদ্যোগের ভিত্তি হচ্ছে মূলত সামাজিক মূলধন, যার অর্থ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আস্থার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় যৌথভাবে কাজ করার প্রেরণা বা প্রবৃত্তি। মানব সম্পদের উৎস যেখানে পৃথক পৃথক ব্যক্তি সেখানে সামাজিক সম্পদের উৎস হচ্ছে সমাজ বা গোষ্ঠীতে এর সদস্যবর্গের পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন। অনেকের মতে, বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে এ জাতীয় সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগের অবক্ষয় ঘটছে এবং এর ফলে বর্তমানে অনানুষ্ঠানিক উদ্যোগ ন্যুনতম পর্যায়ে নেমে গেছে। যেসব কারণে বাংলাদেশে এই সামাজিক সম্পদ এবং প্রশাসনে বেসরকারি উদ্যোগ সীমিত সেগুলোর মধ্যে আছে সামাজিক বন্ধন এবং বেসরকারি প্রশাসনিক উদ্যোগের প্রতিকূল কতিপয় ভূ-পরিবেশগত বিষয় এবং মনুষ্যসৃষ্ট কিছু ঐতিহাসিক কারণ যেমন, দীর্ঘদিন উপনিবেশিক শাসন ও পরবর্তী কয়েক দফা সামরিক শাসনের ফলে সৃষ্ট উগ্র সামাজিক বিভাজন, কর্তৃত্ববাদ ও পারস্পরিক সহিষ্ণুতার অভাবজনিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রণীত আইন ও সবক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রবণতার কারণে একধরনের ‘নজরদারি’ মানসিকতার উদ্ভব হয়েছে এবং অগ্রগতি ব্যাহত করার নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করেছে। এসবের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আদর্শগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় ব্যক্তিকে স্বার্থপরতার দিকে ধাবিত করছে, গোষ্ঠীভিত্তিক উন্নয়নের চিন্তাকে সংকুচিত করছে, গ্রামীণ মানুষের মধ্যে ঈর্ষা-বিদ্বেষ বাড়াচ্ছে এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা সমজাতীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে ব্যহত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনীতিকীকরণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের বহুধা বিভক্তি একটি ক্ষতিকর প্রবণতার সৃষ্টি করছে। অসুস্থ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থানীয় নেতৃত্ব ও জনগণের উদ্যোগ বেগবান হতে পারছে না। জীবিকার তাগিদে কাজের বাধ্যবাধকতায় সমাজকর্মীরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজকর্মকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। [কামাল সিদ্দিকী]