প্রশাসনিক সংস্কার

প্রশাসনিক সংস্কার  বিদ্যমান সরকারি কাঠামো এবং এর কাজের ধরন ঢেলে সাজানো বা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ। স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ যে প্রশাসন ব্যবস্থা লাভ করেছে তা ছিল মূলত উপনিবেশিক ধাঁচের। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানে ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থাই চালু ছিল। পাকিস্তান সরকার এ ব্যবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার তেমন কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করে নি। ফলে প্রশাসনে সাদা সাহেবদের স্থলাভিষিক্ত হন বাদামি সাহেবরা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়টি একের পর এক ক্ষমতায় আসা সবগুলো সরকারের কাছেই একটি বদ্ধসংস্কারের ব্যাপার বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা বাড়ানো সম্ভব হয় না। এর অনিবার্য ফল জনমতের প্রতি অবজ্ঞা এবং অভ্যন্তরিণ সমন্বয়ের অবক্ষয়। এটা সুস্পষ্ট যে, একটি নতুন জাতির অগ্রগতির পথে প্রাথমিক অন্তরায় হচ্ছে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধা। প্রশাসনিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চারের ক্ষেত্রে যুগ যুগ লালিত পুরনো প্রশাসনিক কাঠামো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ অক্ষম। এ কারণে স্বাধীনতার পর থেকে সরকার বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন বা কমিটি গঠন করেছে।

স্বাধীনতা লাভের পর বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান একটি প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে সরকার সমস্যার সম্মুখীন হয়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিভিন্ন পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসনের পুনর্গঠন এবং পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আত্তীকরণের বিষয় পরীক্ষা করে সে সম্পর্কে পরামর্শ দান করা। এ কমিটি ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি এর অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে। এতে প্রশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের জটিলতা পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয়টি সাময়িকভাবে অসম্পূর্ণ রাখা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রাদেশিক সচিবালয়কে জাতীয় সচিবালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। এতে ২০টি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর/বিভাগ ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা রাখা হয়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) সরকার দুটি বড় কমিটি নিয়োগ করে,  প্রশাসন ও চাকুরি পুনর্গঠন কমিটি ১৯৭২ এবং ন্যাশনাল পে কমিশন ১৯৭২। কমিটি/কমিশনকে স্থানীয় সরকারসহ কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের পুনর্গঠন, কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার বিবর্তন এবং একটি জাতীয় বেতন কাঠামো সম্পর্কে প্রস্তাব পেশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়।

এ কমিটি অনুসন্ধানে দেখতে পায় যে বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো বহুধাবিভক্ত। এদের চারপাশে কৃত্রিম দেয়াল সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। পেশায় উন্নতির সুযোগও ভিন্ন ভিন্ন, পেশাগত বৈশিষ্ট্যের অভাব, অতিরিক্ত শ্রেণী ও পদমর্যাদা ভিত্তিক এবং উচ্চ পর্যায়ে উত্তরণের সুযোগ খুবই কম, বিশেষভাবে যারা নিম্নস্তর থেকে বৃত্তি শুরু করেছে। বেসামরিক চাকুরির বাস্তব অবস্থার দিক বিবেচনা করে কমিটি একটি একক শ্রেণীবিহীন গ্রেড-কাঠামোর আওতায় সকল সরকারি চাকুরিকে ১০টি গ্রেডে বিন্যাস করার সুপারিশ করে। এতে দায়িত্ব ও দক্ষতার ওপর বেতন কাঠামোর সংখ্যা যথার্থভাবে নিরূপিত হবে এবং প্রত্যেকটি পদের সঠিক ধাপ নির্ধারণ করা হবে কাজের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। এসব সুপরিশের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রভাবশালী কোনো ক্যাডারের বিলুপ্তি ঘটানো, এবং যাতে বিশেষ কোনো ক্যাডারের জন্য কোনো পদ সংরক্ষণ করা না হয়। এতে যেকোন স্তরে কর্মরত প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য দ্রুত ও সহজে উপরে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে জাতীয় সদর দফতর থেকে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সিনিয়র কর্মকর্তাদের যোগ্যতা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং একই সঙ্গে জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কমিটি প্রশাসনের সকল পর্যায়ে গণতন্ত্রায়নের জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করে এবং আরও ব্যাপকভাবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের এক্তিয়ারে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ সহ জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয়ার সুপারিশ করে। কমিটি এ অভিমত পোষণ করে যে, জাতীয় সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সংস্থাগুলোর ওপর দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে কোনো অপরিবর্তনীয় কঠোরতা অবলম্বন করা উচিত হবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলো যে দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারে সেসকল দায়িত্ব অর্পণ করাই হওয়া উচিত নির্দেশক-নীতি। কমিটি আরও অভিমত প্রকাশ করে যে, থানাই হবে প্রশাসনের মূল ইউনিট এবং এ পর্যায়ে উন্নয়ন প্রশাসনের সকল দায়িত্ব এর উপর ন্যস্ত করা উচিত। এ কমিটির প্রদত্ত সুপারিশে পরিকল্পনা মাফিক মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়। কমিটি প্রণীত সুদূরপ্রসারী এই সুপারিশমালা ঐ সময়ে সরকারের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। সরকার তা শ্রেণীভুক্ত দলিল হিসেবে তুলে রাখে যেমনটি পাকিস্তানি শাসনামলে করা হয়েছিল। প্রশাসন সম্পর্কে অভিজ্ঞ বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়াসই এই কমিটি প্রদত্ত রিপোর্ট ফেলে রাখার অন্তর্নিহিত কারণ।

ন্যাশনাল পে কমিশন যথার্থভাবে প্রণীত একটি সময়োপযোগী বেতননীতি, ভারসাম্যপূর্ণ বেতন কাঠামো এবং প্রশাসনের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যবস্থার সমন্বয়ে একটি বেতন পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে। পে কমিশন তখন সার্ভিস পুনর্গঠন কমিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কাজ চালিয়ে যায়। একটি বাস্তবসম্মত বেতননীতি প্রণয়নের জন্য কমিশন বিভিন্ন পরিবর্তনশীল বিষয় যেমন জীবনযাত্রার ব্যয়, সরকারি সম্পদ, বিদ্যমান বেতন বৈষম্য, বিশেষজ্ঞদের চাকুরিতে ধরে রাখার জন্য আকর্ষণীয় সুবিধা দান ও দক্ষতা অর্জন, সমতা এবং কর্ম উৎসাহ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করতে থাকে। সব কিছু বিবেচনা করে কমিশন অভিমত দেয় যে, পরবর্তী ৫ বছরের জন্য (১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল) নয় সারির প্রশাসনিক কাঠামোর অনুরূপ বেতন স্কেল বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারে। কিন্তু কমিশনের এ অভিমত গৃহীত হয় নি। উপরন্তু সার্ভিস পুনর্গঠন কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত শ্রেণীবিন্যাস ও স্তরের ওপর ভিত্তি করে বেতনস্কেলের সুপারিশ প্রণয়নে কমিশনকে বাধ্য করা হয়। অবশেষে কমিশন ১০ গ্রেড সম্বলিত একটি জাতীয় বেতনস্কেল সুপারিশ করে। এই সুপারিশমালাও আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় এবং তা মাত্র তিন বছর অব্যাহত ছিল। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার পিছনে ছিল সংস্কারের মধ্যেই কিছু সহজাত ত্রুটি বিচ্যূতি। তার ওপর সাধারণ শ্রেণীভুক্ত বেসামরিক কর্মকর্তা বিশেষ করে প্রাক্তন সি.এস.পি ও ই.পি.সি.এস ক্যাডারের কর্মকর্তারা এতে বাধার সৃষ্টি করেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি নতুন করে সরকারি চাকুরি সংক্রান্ত বিষয় এবং বেতন কাঠামো অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সুপারিশ পেশ করতে একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির নাম দেয়া হয় পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন। গঠিত কমিশন এ মত পোষণ করে যে, সাধারণ শ্রেণী বনাম বিশেষ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মধ্যে বদ্ধমূল যে বিতর্ক চলে আসছে তা নিরসনের উপায় হচ্ছে সরকারি চাকুরির অবস্থানগত মানদন্ডের আমূল পরিবর্তন এবং অভিন্ন বেতনস্কেল ও পদোন্নতির বিধান রাখা। কমিশন আরও যুক্তি প্রদর্শন করে যে, কেবল একটি পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে এবং অনেক পদ সংরক্ষিত রাখার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক সাধারণ ক্যাডার সৃষ্টি করা উচিত নয়। চাকুরি ও কেন্দ্রীয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল, পূর্বতন সকল চাকুরি এবং পরবর্তী কালের সরকারি সেক্টরসহ সকল বেসামরিক চাকুরি একীভূত করা, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধানীতির উপর গুরুত্ব আরোপ, প্রাথমিক পর্যায়ে সমান বেতনস্কেল এবং ন্যায়সঙ্গত সুযোগ প্রদান করে প্রশাসনিক পদোন্নতির ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সি.এস.পি ও অন্যান্য চাকুরির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যের অবসান। প্রথমদিকে কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সরকার দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। অবশ্য দুবছর পর সরকার কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করে যদিও কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে। এর ফলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ২৮ টি ক্যাডার সৃষ্টি হয়, সিনিয়র সার্ভিসেস পুল গঠিত হয় এবং প্রবর্তন করা হয় নতুন জাতীয় গ্রেড ও বেতন স্কেল।

সুপারিশকৃত বেসামরিক চাকুরি কাঠামোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সরকারি নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিনিয়র সার্ভিসেস পুল গঠন। নতুন বেসামরিক চাকুরি কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এক শ্রেণীর ওপর অন্য শ্রেণীর প্রভুত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি শ্রেণীহীন  আমলাতন্ত্র সৃষ্টি। কিন্ত বাস্তবায়ন পর্যায়ে পুলের সদস্যভুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়মিত পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়। এক দশকেরও বেশি এই ব্যবস্থা চালু থাকার পর ১৯৮৯ সালে তা বিলোপ করা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, শীর্ষ অবস্থান গুলিতে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে এ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে।

সুপারিশকৃত বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন বিভাগকে এমন একটি সঙ্গত বেতন পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়, যাতে স্কেলের সংখ্যা খুব কম না হয় আবার খুব বেশিও না হয় (যেমনটি কমিশন সুপারিশ করেছিল)। এ অবস্থায় বাস্তবায়ন বিভাগ উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে একটি বেতনস্কেল প্রণয়ন করে। ১৯৭৭ সালে সার্ভিসেস (গ্রেড, পে অ্যান্ড অ্যালাউন্সেস) অর্ডার নামে একটি আদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারি খাতের চাকুরিজীবীদের জন্য ২১টি গ্রেডে বেতনস্কেল প্রবর্তন করে। কিন্তু পরিশেষে বাস্তবায়ন পর্যায়ে সরকার বেতন কাঠামো আংশিক পরিবর্তন করে। কতিপয় কর্মকর্তার (বিশেষভাবে জেলা পর্যায়ে) অসন্তোষ নিরসনের জন্য সরকার ৬ষ্ঠ ও ৭ম গ্রেডকে একীভূত করে এবং তাদের বেতন সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। এভাবেই কমিশনের সুপারিশমালা ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে কার্যকর হয়। তখন থেকেই এই বেতনস্কেল চালু হয়েছে এবং বাজারে দ্রব্যমূল্যের অবস্থা এবং মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য মাঝেমধ্যে বেতন কাঠামোর পরিবর্তন আনা হয়েছে।

জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। গ্রামে এ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ধারণা নিয়ে ১৯৮০ সালে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার আইন পাস হয়। এ আইনের অধীনে একজন গ্রাম প্রধান, দুজন মহিলা সদস্য এবং গ্রামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী অপর নয় জন সদস্য নিয়ে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার গঠিত হয়। গ্রাম নির্বাচনী তালিকায় নাম রয়েছে এমন সচেতন গ্রামবাসীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে সর্বসম্মতক্রমে গ্রাম প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা মনোনীত হন। স্বনির্ভর গ্রাম সরকারকে ৪টি প্রধান কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব দেয়া হয়: খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো, নিরক্ষরতা দূর করা, পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য স্বনির্ভর গ্রাম সরকারকে তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতা দেয়া হয় নি। গ্রাম সরকারকে এতোটাই প্রাধান্য দেয়া হয় যে, এটি জাতীয় সরকারের পরেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে। কিন্তু এর সহজাত সাংগঠনিক সমস্যা এবং জনগণের নির্লিপ্ততার ফলে কার্যত এ ব্যবস্থাটি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৮২ সালে বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা নেয়ার পর সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ স্বনির্ভর গ্রাম সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব গ্রহণের পর পরই জেনারেল এরশাদ প্রশাসনিক সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। তিনি দুটি বড় ধরনের কমিটি গঠন করেন। এর একটি হলো মার্শাল ল’ কমিটি এবং অপরটি  প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি। মার্শাল ল’ কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয় মন্ত্রণালয়/ বিভাগ এবং এর অধীনে বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরগুলোর গঠন কাঠামো পরীক্ষা করে দেখা এবং বেসামরিক চাকুরির ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে সুপারিশ করা। এ কমিটি সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত করার ক্ষেত্রে কতিপয় জোরালো ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশের মধ্যে রয়েছে মন্ত্রণালয়/বিভাগের সংখ্যা এবং বেসামরিক কর্মচারী বিশেষ করে নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের সংখ্যা হ্রাস করা; সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপগুলো কমানো; সচিবালয় ও অন্যান্য নির্বাহী সংস্থাগুলোর কাজ ঢেলে সাজানো; নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর বিধিবিধানুগ ও নিয়মিতকরণ। সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপগুলো কমানো ব্যতীত কমিটি প্রদত্ত অপর সুপারিশ সামরিক সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়। প্রশাসনিক সংস্কার কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ ও জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি যথোপযুক্ত, সুষ্ঠ ও কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুপারিশ প্রণয়নের। কমিটির পেশকৃত সুপারিশে বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি স্তরে অর্থাৎ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একজন প্রধান নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান থাকবেন মূল সমন্বয়কারী এবং তার অধীনে পর্যাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকবে; প্রত্যেকটি পর্যায়ে নির্বাচিত পরিষদের উপর ন্যস্ত থাকবে সংশ্লিষ্ট স্তরের সকল কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ ও কর্মচারীদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হবে; প্রশাসনিক স্তর হিসেবে মহকুমা ও বিভাগকে বাতিল করা হবে; নিম্নস্তরের পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে নিকটতম উচ্চতর স্তরের পরিষদের সদস্য থাকবেন এবং উপজেলা পর্যায় থেকেই উন্নয়নের ভৌত কাঠামো সৃষ্টি হবে। জেনারেল এরশাদ এই কমিটি কর্তৃক পেশকৃত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণের জন্য আরও একটি কমিটি গঠন করেন। এটি হলো ন্যাশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্ম/ রিঅর্গানাইজেশন। এই কমিটির সুপারিশের ফলস্বরূপ স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হয় উপজেলা প্রশাসন।

উপজেলার সকল ভোটারের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসন পরিচালিত হতো। উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়েছিল নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যান, প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য, মহিলা সদস্য, দাপ্তরিক সদস্য, সংশ্লিষ্ট উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান এবং মনোনীত সদস্যদের নিয়ে। এতে ছিল দুই শ্রেণীর সদস্য, ভোটাধিকারসহ সদস্য এবং ভোটাধিকার বিহীন দাপ্তরিক সদস্য। উপজেলা পরিষদকে বাংলাদেশের সকল প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। উপজেলা পরিষদের ওপর অর্পিত কার্যাবলি ও দায়িত্ব ছিল বিস্তৃত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিষদের প্রধান কাজ ছিল কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াত ইত্যাদি সহ প্রধান প্রধান কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করে উপজেলার জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্ত্তত করা। এ পরিষদ উপজেলা পর্যায়ে গৃহীত সরকারি নীতি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত। অন্যান্য কার্য সম্পাদনের পাশাপাশি উপজেলা পরিষদ সময়ে সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অর্পিত দায়িত্বও পালন করত। উপজেলার আওতাধীন সকল পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করত উপজেলা পরিষদ। কার্যত উপজেলা পরিষদ একটি ‘আত্মবিরোধী বিভক্ত ঘর’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর কারণ হলো দুই শ্রেণীর কর্মকর্তা অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা ও জন প্রতিনিধিদের মধ্যে বিরোধ। তথাপি সরকারের স্থানীয় স্তরকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দানের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণের জন্য কমিটি যে পন্থার সুপারিশ করেছিল, তা বাস্তবায়িত হয়। স্থানীয় সরকারের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় আমলাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয় স্থানীয় পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে।

১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। যুক্তি দেখানো হয় যে, এ পদ্ধতি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতির স্বাক্ষর রাখতে পারে নি। এর কর্মকর্তাদের হাতে অর্থের অপচয় হয়েছে, দুর্নীতি বেড়েছে এবং অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ ব্যয় বেড়েছে। রাষ্ট্রের মধ্যে স্থানীয় সরকারের অবস্থা নতুন করে অনুসন্ধানের জন্য খালেদা জিয়ার সরকার একটি কমিশন গঠন করে। এ কমিশনকে সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করতে বলা হয়, যাতে তৃণমূল পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য অনুধাবন করে এ কমিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে। কমিশন শহর এলাকায় ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের জন্য পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন গঠনের সুপারিশ করে। এতে গ্রামকে স্থানীয় সরকারের মৌলিক ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়। তদনুসারে ভোটার তালিকার অন্তর্ভুক্ত গ্রামবাসীর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ১০ সদস্য সমন্বয়ে গ্রামসভা গঠনের সুপারিশ করা হয়। এই পুনর্গঠিত ব্যবস্থায় ইউনিয়নকে বিবেচনা করা হবে আর্থসামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এবং গ্রাম হবে উন্নয়নের মৌলিক ইউনিট। সংস্কারের এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই রাজনৈতিক গোলযোগের মুখে খালেদা জিয়ার সরকারের পতন ঘটে। বিএনপির শাসনামলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইউ.এন.ডি.পি কর্তৃক প্রণীত ‘পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এফিসিয়েন্সী স্টাডি’, চারজন সচিব কর্তৃক প্রণীত ‘টুয়্যার্ডস বেটার গভর্নমেন্ট’ এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রণীত ‘গভর্নমেন্ট দ্যাট ওয়ার্কস’। কিন্ত এসব রির্পোটের কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয় নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ দেশের স্থানীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করে। কমিশন স্থানীয় সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে জরিপ চালিয়ে গ্রাম পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদ নামে চার স্তরের স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের সুপারিশ করে। স্থানীয় সরকার পদ্ধতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কমিশন স্থানীয় সরকারের ইউনিটগুলির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, পর্যালোচনা এবং তত্ত্বাবধানের জন্য নির্বাহী নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি স্থায়ী লোকাল গভর্নমেন্ট কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। কেন্দ্রীয় সরকার তার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তা সমাধানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার একটি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে। গঠিত কমিটি ২০০০ সালের মে মাস পর্যন্ত এসম্পর্কে কোনো রিপোর্ট পেশ করে নি।

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কিছুটা সংস্কার হয়েছে। কিন্ত স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই স্থবিরতা বিরাজ করছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক্ষেত্রে সংস্কারের নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে চলেছে পরীক্ষা নিরীক্ষা। উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ এবং কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণের মতো বাস্তব বিষয়গুলো ব্যক্তি বিশেষের সমর্থনের ভিত্তি রচনার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। একদল বা ব্যক্তি ক্ষমতায় এসে পূর্বসুরী অন্য দল বা ব্যক্তির সমর্থনের ভিত্তি ধ্বংস করে দিচ্ছে।  [এ.টি.এম ওবায়দুল্লাহ]