পেশাজীবী কারিগর
পেশাজীবী কারিগর নির্দিষ্ট পেশায় দক্ষ শ্রমিক বা জনগোষ্ঠী। কোন জিনিস তৈরি করতে প্রধানত কায়িক শ্রম এবং সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগকারীকে কারিগর বলা হয়। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে এ শ্রেণির লোকজন হাতে বানানো দ্রব্যাদি, হস্তশিল্প এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত যন্ত্রপাতি প্রস্ত্ততের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সভ্যতা মানেই আমাদের সৃষ্ট সবকিছুর সমবায় এবং কারিগরদের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত কর্মদক্ষতার বহিঃপ্রকাশও এর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য, কারিগর ও পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে। সকল কারিগরই আবশ্যিকভাবে পেশাজীবী শ্রেণিভুক্ত। কিন্তু সকল পেশাজীবী শ্রেণিই কারিগর নয়, যেমন একজন নাপিত কারিগর শ্রেণিভুক্ত নয়, একজন কামার কারিগর এবং পেশাজীবী উভয় শ্রেণিভুক্ত।
কোন বিশেষ অঞ্চলে কোন পেশাজীবী বা কারিগর শ্রেণির আবির্ভাব ও উন্নয়ন সেই অঞ্চলের আর্থসামাজিক এবং পরিবেশগত কাঠামোর সাথে গভীর সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। মাটির প্রকৃতি, আবহাওয়া, পানির প্রাপ্যতা পৃথক পৃথক পেশাজীবী এবং কারিগর শ্রেণির গড়ে উঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই গাঙ্গেয় উপত্যকার সমতল পাললিক ভূমিতে বিকশিত পেশাজীবী শ্রেণিসমূহ নির্জন তুন্দ্রা অঞ্চলের পেশাজীবী শ্রেণির তুলনায় সর্বদাই ছিল স্বতন্ত্র। কামার, কুমার, তাঁতি শ্রেণির মতো কারিগর সম্প্রদায় কৃষিজীবী সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য বিকশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে, রাখাল সমাজ পশুপালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগর শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। একটি সমাজের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বিকাশমান কারিগর শ্রেণির ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। প্রাথমিক ধরনের যন্ত্রপাতি-সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী সমাজ সাধারণ চরিত্রের পেশার প্রকাশ ঘটায়। অপরদিকে শিল্পায়িত সমাজে বিশেষ ও জটিল ধরনের পেশার প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে কারিগরদের বিকাশ কতগুলি সাধারণ প্রবণতা অনুসরণ করেছে, যদিও তা সময়বিশেষে সুবিধাজনক এলাকায়ই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কারও কারও শহরে বা গ্রামে বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ঘর রয়েছে, যা তাদেরকে সমাজে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে। এই বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে সংস্কৃতি, আদর্শ, মূল্যবোধ, লোকজ পদ্ধতি, এমনকি খাদ্যাভাসও অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেহেতু কারিগরগণ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়, ধর্মীয় বিভাজনের দিক থেকে তারা সুনির্দিষ্ট বা গোঁড়া অবস্থান গ্রহণ করে না। কিছু কিছু পেশাজীবী গোষ্ঠীতে পারিবারিকভাবে দাপ্তরিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। অতীতে বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীকে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বর্ণপ্রথানুযায়ী চিহ্নিত করা হতো। হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বনিম্ন জাত হিসেবে চিহ্নিত অধিকাংশ শূদ্রদের বিশেষ ধরনের কর্মে নিয়োগ করা হতো। অধিকাংশই অর্পিত কাজকে নিজের প্রকৃত পেশা বলে বিশ্বাস করত। এদের অধিকাংশই ছিল অস্পৃশ্য শ্রেণিভুক্ত, এমনকি কতিপয় দাস শ্রেণিকে অভিজাতদের চোখে দেখারও অযোগ্য গণ্য করা হতো। তারা কেবল রাতের বেলায় ঘরের বাইরে আসতে পারত। বঙ্গে শিক্ষার প্রসার এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের সাথে সাথে অধিকাংশ পেশাই তাদের বর্ণপ্রথা হারিয়ে ফেলেছে। কতিপয় নির্দিষ্ট বর্ণের বহু সদস্যই শিক্ষিত হয়েছে এবং অন্য পেশায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। তাছাড়া, মিশ্র সাংস্কৃতিক ধারা ও ধর্মীয় পটভূমিসম্পন্ন লোকজনও একদা বর্ণচিহ্নিত পেশাসমূহে যোগ দিয়েছে।
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অতীতে বিকশিত বিভিন্ন বৃত্তি ও পেশার এবং তাদের ওপর অর্পিত কাজের বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় উৎসবাদি এবং শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আচার-আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালনের দায়িত্ব দেওয়া হতো। কুষ্ঠীরা জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন, বৈদ্যগণ চিকিৎসাশাস্ত্রে, বৈশ্য ও গোপগণ কৃষিক্ষেত্রে, গোয়ালাগণ দুধ ও খামারজাত দ্রব্য উৎপাদনে, মালিগণ বাগান করা ও ফুলের ব্যবসায়, বাড়ৈগণ পানচাষে, নাপিতগণ কেশবিন্যাসে, মোদক ও ময়রাগণ মিষ্টি তৈরিতে এবং লাঠিয়াল বলে পরিচিত বাগদিগণ গ্রাম পাহারায় নিয়োজিত ছিল। ধোপা বা রজক, সূত্রধর বা ছুতার, ধাঙ্গড়, ডোম এবং চন্ডালগণকে সমাজের সর্বনিম্ন শ্রেণি বলে গণ্য করা হতো এবং তারা শহর বা গ্রামের প্রান্তে বসবাস করত। তাছাড়া, তাঁতি, জেলে বা ধীবর, গহূবণিক, গোপ, কামার, কুমার, কলু, কাঁসারু, শাঁখারি, স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, মাঝি, ঘরামি, কাহার, করাতি, পাতিয়াল প্রভৃতি পেশাজীবী গোষ্ঠীও ছিল। [গোফরান ফারুকী]