পালিত, স্যার তারকনাথ
পালিত, স্যার তারকনাথ (১৮৩১-১৯১৪) আইনজীবী, সমাজহিতৈষী। ১৮৩১ সালে কলকাতায় জন্ম হলেও তাঁর বাল্য ও কৈশোর কাটে হুগলি জেলার ওমরপুরে। ধনাঢ্য পিতা কালীশঙ্কর পালিতের একমাত্র সন্তান তারকনাথ পড়াশোনা করেন কলকাতার হিন্দু কলেজে। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন প্রথম বাঙালি সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে তারকনাথ আইনব্যবসা শুরু করেন এবং অল্পদিনেই প্রভূত খ্যাতি ও অর্থের অধিকারী হন। পিতা কালীশঙ্কর ছিলেন একজন হূদয়বান ব্যক্তি। তাঁর অর্থে তৎকালীন কলকাতার অনেকেরই ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে। অপরিমিত দানশীলতার কারণে তিনি নিজের একমাত্র সন্তানের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। পিতার এই গুণাবলি তারকনাথের মধ্যেও ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।
তারকনাথ ছিলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন অক্লান্ত কর্মী। পরে অবশ্য মতভেদের কারণে তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করেন। দেশের জনগণকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে তিনি একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এ কাজে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন কাসিমবাজারের মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। একবার তিনি এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারি কারিগরি স্কুলের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব দিলে কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাকে কর্মমুখী করার অভিপ্রায়ে তিনি তাঁর উদ্যোগ অব্যাহত রাখেন। এ প্রতিষ্ঠানের খরচ বাবদ তিনি প্রতি মাসে দু হাজার রূপি দান করতেন। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানশিক্ষায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর আজীবনের সঞ্চয় ১৫ লাখ টাকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। পরে তিনি তাঁর বসত বাড়িটিও এ মর্মে দান করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর স্বত্বাধিকারী হবে।
রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি যে অর্থ দান করেন তাতে একটি শর্ত ছিল যে, এ বিষয়ের অধ্যাপককে অবশ্যই ভারতীয় হতে হবে। ভারতীয়দের মধ্যে উপযুক্ত কাউকে না পাওয়া গেলে দেশিয় কোনো অধ্যাপককে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ করে আনতে হবে। তাঁর দানকৃত অর্থ এবং স্যার রাসবিহারী ঘোষের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলকাতা সায়েন্স কলেজ’। এভাবে তারকনাথ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিজ্ঞানশিক্ষার এক শক্ত ভিত তৈরি করেন। সমাজের প্রতি তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯১৩ সালে তাঁর নামে সম্মানসূচক ‘অধ্যাপক বৃত্তি’ প্রবর্তন করা হয়, যা পরবর্তীকালে ‘ডক্টর অব ল’ নামে পরিচিত হয়। একই বছর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে।
তারকনাথের চেষ্টা ছিল শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের অর্থনীতি বিজ্ঞানশিক্ষা ও শিল্পায়নের ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় চেতনা ও জাতীয় উন্নয়ন ছিল তাঁর চিন্তার মূল বিষয়। এ ব্যাপারে তিনি ধর্মবর্ণের ঊর্ধ্বে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি স্যার হেমিলটন, জেমস মিল ও হার্বার্ট স্পেনসারের দর্শন ও চিন্তাদ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
তারকনাথ আজীবন মানবকল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অস্পৃশ্যতা এবং অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কারের প্রবল বিরোধী ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য, বিশেষত শেক্সপীয়রের রচনার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। ১৯১৪ সালের ৩ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। [মোঃ মাসুদ পারভেজ]