পাললিক মৃত্তিকা
পাললিক মৃত্তিকা (Alluvial Soil) পললভূমি ও বদ্বীপ অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াধীন নবীন মৃত্তিকা। এসব মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যগুলো পললের মতো। পুরাতন পাললিক মৃত্তিকাগুলোতে প্রায়ই ‘ক্যামবিক’ ক্ষিতিজের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এসব মৃত্তিকাকে ইউএস সয়েল ট্যাক্সোনমির ইনসেপটিসলস বর্গের মৃত্তিকা হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে নবীন মৃত্তিকাগুলোকে এন্টিসলস বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পাললিক মৃত্তিকাগুলো মানব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অন্য যেকোনো বৃহৎ মৃত্তিকা গ্রুপের চেয়ে এসব মৃত্তিকার উপর জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ জীবন ধারণের জন্য নির্ভর করে। পাললিক মৃত্তিকাতেই সব প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। বিখ্যাত মেসোপটেমীয় ও নীল উপত্যকার সভ্যতা যথাক্রমে দজলা ফোরাত (Euphrates-Tigris) এবং নীল নদের পললভূমি মৃত্তিকাতেই উদ্ভব ঘটেছিল। ইন্দো-গাঙ্গেয় বিশাল সমতল ভূমির পাললিক মৃত্তিকাতে শত শত বছর ধরে বিরাট জনসংখ্যাকে ধারণ করে আছে।
যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি সহজলভ্য হয় তবে বৈচিত্রময় উৎস বস্ত্ত থেকে উৎপন্ন অধিকাংশ পাললিক মৃত্তিকা অত্যন্ত উৎপাদনশীল হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন নদীর অববাহিকার পলল বস্ত্ত স্বতন্ত্র ধর্মাবলি সম্পন্ন। উদাহরণস্বরূপ, গাঙ্গেয় পলল চুনযুক্ত এবং এদের বিক্রিয়া (pH) ক্ষারীয়। কোন কোন স্থানের পললে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্যালসিয়াম কার্বনেট থাকে। ব্রহ্মপুত্র নদের পলল চুনহীন এবং এসিডীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন। বাংলাদেশের ভূভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় পাললিক মৃত্তিকা বিদ্যমান এবং এসব মৃত্তিকাতে অধিক পরিমাণে মাইকা থাকে। পাললিক মৃত্তিকাগুলো বয়স, গ্রথন বা মণিক প্রকৃতির দিক থেকে অসমসত্ত্ব। এসব পলল বিভিন্ন এলাকাতে ভিন্ন ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থায় অবক্ষেপিত হয়েছে: হিমালয় পর্বতসহ পাহাড়ের পাদদেশের নিকটস্থ সানুদেশীয় সমতলভূমি, নদীজ পললভূমি, মোহনাজ পললভূমি এবং জোয়ার প্রভাবিত পললভূমি।
পলি সঞ্চিত হওয়ার সময় তুলনামূলকভাবে স্থূলাকার বস্ত্তগুলো এদের উৎসস্থল থেকে বহুদূর পর্যন্ত বাহিত হয় না। পাললিক বস্ত্তর গ্রথন পরিবাহিত এলাকার দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে অধিক সমরূপ ও মিহি হয়। দেশের আড়াআড়ি উত্তর থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পলল বস্ত্তর গ্রথন তুলনামূলকভাবে মিহি হয়ে থাকে। এখানকার অধিকাংশ পাললিক মৃত্তিকা অতি উর্বর ও অধিক উৎপাদনশীল। এসব মৃত্তিকার অনেকগুলোতেই ভালো ধান উৎপন্ন হয়। উপকূল এলাকা বরাবর অবস্থিত কিছু কিছু মৃত্তিকা জোয়ারের ক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে লবণাক্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের পাললিক মৃত্তিকাকে কতকগুলো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: চুনহীন পলল, চুনযুক্ত পলল, এসিড সালফেট মৃত্তিকা, পিট মৃত্তিকা, চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, চুনযুক্ত ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, চুনহীন গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, ধূসর সানুদেশীয় মৃত্তিকা, অম্ল অববাহিকা মৃত্তিকা, চুনহীন বাদামি পললভূমি মৃত্তিকা, চুনযুক্ত বাদামি পললভূমি মৃত্তিকা এবং কালো তরাই মৃত্তিকা।
বাংলাদেশের পাললিক মৃত্তিকাতে প্রায়ই ক্যাম্বিক ক্ষিতিজ সৃস্টি হয়। এ ক্ষিতিজের উপস্থিতির কারণে এসব মৃত্তিকাকে ইউএস সয়েল ট্যাক্সনমির inceptisols বর্গের মৃত্তিকা হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে নবীন পাললিক মৃত্তিকাগুলোকে Entisols বর্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নিচু এলাকার পাললিক মৃত্তিকা যখন ফেটে যায় তখন পৃষ্ঠ মৃত্তিকা বস্ত্ত বন্যার পানির সঙ্গে ফাটলে ঢুকে পড়ে এবং মৃত্তিকা পৃষ্ঠে প্রলেপন তৈরি করে। এ ধরনের প্রলেপন আমাদের দেশের অনেক মৃত্তিকারই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অনেক পাললিক মৃত্তিকার পরিলেখে ভু-জল সারা বছর ধরে উঠা-নামা করে। একারণে এসব মৃত্তিকাতে পর্যায়ক্রমে জারণ ও বিজারণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পাললিক মৃত্তিকাতে প্রায়ই গ্লাইজেশন (gleization) প্রক্রিয়াটি সাধারণ মৃৎজনি প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। পাললিক মৃত্তিকাতে সুনিষ্কাশিত অবস্থাও থাকতে পারে। [মোহাম্মদ সুলতান হোসেন]