পানি নিষ্কাশন প্রণালী
পানি নিষ্কাশন প্রণালী (Drainage Pattern) উজান থেকে ভাটিতে পানি প্রবাহের পদ্ধতি। এক্ষেত্রে প্রধান মাধ্যম হলো নদী। উৎস স্থান থেকে একটি নদী ঢালুপথ বরাবর অগ্রসর হয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানের জন্যই এই রীতি। বিন্দু বিন্দু জল একত্রে একটি জলধারা গঠন করে। বিভিন্ন দিক থেকে উপধারা (tributaries) এসে যুক্ত হয়ে জলধারার পানির পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে। এভাবে একটি জলধারা বৃহদাকৃতি ধারণ করে নদীর রূপ নেয়। নিষ্কাশন অববাহিকার (drainage basin) অন্তর্গত ভূমি থেকে নদী ও উপনদীগুলি তাদের জল সরবরাহ লাভ করে থাকে। একটি নদীর উৎস স্থান থেকে নিম্ন প্রবাহের দিকে তাকালে এর শাখা-প্রশাখাসমূহ পরিদৃষ্ট হয়। একটি নদীর উপনদীসমূহের ক্রমসজ্জার বিন্যাসকে জলনিষ্কাশন ধরন বা বিন্যাস বলা হয়ে থাকে। নিষ্কাশন অববাহিকায় জলপ্রবাহসমূহের পারিসরিক বিন্যাস সম্পর্কিত একাধিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা গিয়েছে যে, জলপ্রবাহের নেটওয়ার্ক অল্প কয়েক প্রকার বিন্যাস- ধরন অনুসরণ করে থাকে। বিভিন্ন এলাকার ভূ-প্রকৃতি এবং ভিন্ন ভিন্ন ক্ষয় প্রতিরোধক্ষম শিলার বণ্টন প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ ধরনের জলনিষ্কাশন বিন্যাস গড়ে উঠেছে। বিন্যাসের আকৃতি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট এলাকার শিলাস্তর, মৃত্তিকা, জলবায়ু এবং নদ-নদীর গতিপ্রবাহ পরিবর্তনের ওপর। একটি এলাকার জলনিষ্কাশন বিন্যাস সংশ্লিষ্ট এলাকার অন্তর্নিহিত শিলাস্তরের প্রকৃতি, ভূ-গাঠনিক চিত্র, ভূ-খন্ডের প্রকৃতি, ভূ-সংস্থান প্রভৃতির উত্তম নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বৃক্ষের ডালপালা সদৃশ প্রশাখী জলনিষ্কাশন বিন্যাস (dendritic pattern) জলধারা সমূহের এলোমেলো সম্মিলনের ফলে গঠিত হয়। পরিমিত ঢাল এবং নদীক্ষয়ের প্রতি সুষম প্রতিরোধক্ষম শিলাস্তরবিশিষ্ট ভূমিরূপে এ ধরনের জলনিষ্কাশন বিন্যাস দেখা যায়। সুতরাং প্রশাখী বা বৃক্ষসদৃশ জলনিষ্কাশন বিন্যাস কোন অঞ্চলের সমতল পলিজ ভূমি অথবা সমসত্ত্ব কেলাসিত শিলাস্তর যার সমরূপ ক্ষয় প্রতিরোধের ওপর ভূ-গাঠনিক নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত এমন ভূমিরূপকে নির্দেশ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বৃহত্তর বঙ্গীয় সমভূমি, অ্যাপালেশিয়ান মালভূমি প্রভৃতি স্থানের জলনিষ্কাশন ধরন প্রধানত প্রশাখী বা বৃক্ষসদৃশ।
তুলনামূলকভাবে অত্যধিক খাড়া ঢালবিশিষ্ট একই ধরনের শিলাস্তরের উপর সমান্তরাল জলনিষ্কাশন বিন্যাস (parallel drainage pattern) দেখা যায়। ভিন্নতর এক ধরনের জলনিষ্কাশন বিন্যাস সৃষ্টি হয় যখন শিলা এককগুলি সমান্তরালভাবে পর্যায়ক্রমে দুর্বল ও শক্তিশালী শিলাস্তর হিসেবে সজ্জিত বা বিন্যস্ত থাকে। নদ-নদীগুলি সাধারণত ক্ষয়কার্যের প্রতি কম প্রতিরোধক্ষম শিলাস্তরকে অনুসরণ করে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা দেখায় এবং সে কারণে জাফরী সদৃশ জলনিষ্কাশন বিন্যাস (trellis pattern)-এ প্রাথমিক উপনদীগুলি প্রধান জলপ্রবাহের সঙ্গে সমকোণে মিলিত হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের উপনদীগুলি মূল প্রবাহের সঙ্গে সমান্তরালে প্রবাহিত হয়। বৃহৎ নদীসমূহ অপ্রতিরোধ্য শিলাবলয় দখল করে থাকে। অপরপক্ষে, ক্ষুদ্র ও ছোট নদীসমূহ প্রতিরোধক্ষম শিলাবলয় এবং ভু-সংস্থানিক দিক থেকে উচ্চতর নদীতলবিশিষ্ট অঞ্চলের জলনিষ্কাশন করে থাকে। আনত (tilted) অথবা ভাঁজবিশিষ্ট (folded), পর্যায়ক্রমে দৃঢ় ও অদৃঢ় পাললিক শিলাস্তরের অনুক্রমবিশিষ্ট ভূ-প্রকৃতি জাফরী সদৃশ জলনিষ্কাশন বিন্যাস প্রদর্শন করে। হিমবাহ সঞ্চিত ড্রামলিন (drumlin) ভূমিরূপ অথবা সৈকত শৈলশিরার মতো সমান্তরাল প্রলম্বিত ভূমিরূপবিশিষ্ট অঞ্চলেও এ ধরনের জলনিষ্কাশন বিন্যাস গঠিত হয়ে থাকে। ভাঁজবিশিষ্ট অ্যাপালেশিয়ান এবং পূর্ব বলিত বলয় ও বঙ্গীয় সমভূমির অন্তর্গত বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে এ ধরনের জলনিষ্কাশন ধরন বিদ্যমান। সাধারণত বেলেপাথর এবং শেলপাথর (shale) এর পর্যায়ক্রমিক অবস্থান যা দেশের পার্বত্য ভূতাত্ত্বিক গঠনে সাধারণত দেখা যায়, সেখানকার ভূমিরূপ জাফরী সদৃশ নিষ্কাশন ধরন গঠনে সহায়তা করে থাকে।
যেসকল এলাকার জলনিষ্কাশন বিন্যাসে চ্যুতি ও গ্রন্থি প্রধান নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে সেখানে আয়তাকার জলনিষ্কাশন ধরন (rectangular drainage pattern) সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ধরনের জলনিষ্কাশন বিন্যাসে জলধারাগুলো দুদিক থেকে সমভাবে পরস্পরের সঙ্গে লম্বভাবে মিলিত হয়ে জালিকা গঠন করে থাকে। এ ধরনের নদীখাতসমূহ লম্বালম্বি একাধিক গ্রন্থি দ্বারা কর্তিত সুষম প্রতিরোধক্ষম শিলাস্তরের বৈশিষ্ট্যকে উপস্থাপন করে। নদীপ্রবাহসমূহ গ্রন্থি বরাবর ফাটল (fracture) ও বিচূর্ণীভবনের (weathering) ফলে সৃষ্ট শিলাস্তরের কম প্রতিরোধক্ষম অংশকে অনুসরণ করে প্রবাহিত হয়। পাললিক পার্বত্য ভূখন্ডে এ ধরনের নদীখাত খুবই সাধারণ। বাংলাদেশের পূর্বভাগের পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে পাললিক শিলা খুব বেশি চ্যুতি ও গ্রন্থি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেখানে আয়তাকার নিষ্কাশন বিন্যাস দেখা যায়। [কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ]