পাদুকা শিল্প
পাদুকা শিল্প বলতে জুতা উৎপাদন ও বিক্রির কাজে নিয়োজিত শিল্পকে বোঝায়। কতগুলো কারণে পাদুকা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। প্রথমত খাদ্য, বাসস্থান, জামা-কাপড়ের মতই জুতা একটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয়ত এটি একটি শ্রম-নির্ভর প্রক্রিয়া যা প্রচুর সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। তৃতীয়ত স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চামড়া শিল্পের সাথে পশ্চাদমুখী সংযোগ এবং বিপণন ও বিক্রির কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অগ্রমুখী সংযোগ স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে পাদুকা শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানির মধ্যে তুলনামূলক সুবিধা অর্জন করে এগিয়ে চলেছে।
ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তেমন কোন বৃহৎ জুতার কারখানা ছিল না। তখন মূলত কলকাতা থেকে জুতা আমদানি করা হতো। কিন্তু ১৯৬২ সালের দিকে প্রথমত তদানিন্তন পূর্ব বাংলায় বাণিজ্যিকভাবে জুতা উৎপাদন শুরু হয়, যার একটি ব্রান্ড নাম ছিল ‘বাটা’এবং প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘বাটা স্যু কোম্পানি’। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ইপ্সি জুতা উৎপাদন ও রপ্তানি আরম্ভ করে। এর রপ্তানির দেশগুলো ছিল ইউ.এস.এস.আর, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং ইংল্যান্ড। এটিই ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রথম এদেশের জুতা রপ্তানির প্রথম ঘটনা। এ শিল্পে এখন উৎপাদন ইউনিটের সংখ্যা ২০০০ অতিক্রম করেছে। অধিকাংশ ইউনিটই হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকৃতির এবং ২৩টি ইউনিট তুলনামূলকভাবে বৃহৎ অকারের হলেও কারিগরি দিক থেকে যন্ত্রচালিত ও হস্তচালিত উভয় ধরনের রয়েছে। এ শিল্পের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩২ মিলিয়ন জোড়া জুতা যার মধ্যে চামড়া ও চামড়া বহির্ভূত উভয় ধরনের কাঁচামাল অন্তর্ভূক্ত । প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭৫০-৩০০০ জোড়ার মধ্যে উঠানামা করে।
পাদুকা শিল্প এর বাজারসমূহে বৈচিত্র্যময় জুতা সরবরাহ করে থাকে যার উদ্দেশ্য থাকে সর্বোচ্চ মূল্য অর্জন করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ শিল্প বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করে যেমনÑ চামড়ার জুতা, খেলাধূলার জুতা, কাপড়ের স্যান্ডেল, পাটের জুতা, চপ্পল এবং জুতার তলির উপরিভাগ। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পাদুকা শিল্প এর পশ্চাদ ও সম্মুখ সংযোগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবমিলে প্রায় ৫০,০০০ লোক নিয়োজিত রয়েছে। এখন পর্যন্ত জুতা বিক্রির ক্ষেত্রে পাদুকা শিল্প অভ্যন্তরীণ বাজারেই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তবে নামিদামী ব্রান্ড-এর বাজার শেয়ার উর্ধ্বমুখী এবং তা অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশের সমান। এছাড়াও পাদুকার বাজার বছরে ১২% থেকে ১৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাদুকা শিল্পের ব্যবসায় চক্রাকার প্রভাব বিদ্যমান কারণ একমাত্র ঈদ-উল ফিতরের সময় ২৫% থেকে ৩০% জুতা বিক্রি হয়ে থাকে। স্থানীয় বাজারে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে এমন কতিপয় ব্রান্ড হচ্ছে- বে, হেমকো, জেনি, ফরচুনা, ক্রিমেন্ট, ভাইব্রেন্ট, ওয়াকার ওরিয়ন, ফেলকন, জেইলস্, সাম্পান প্রভৃতি।
১৯৬৭ সাল থেকেই জুতা রপ্তানি হয়ে আসছে এবং এর প্রবৃদ্ধির হার উর্ধ্বমুখী হলেও বার্ষিক প্রবৃদ্ধি খুবই দুর্বল। ১৯৭২ সালে ০.১৪ মিলিয়ন টাকা থেকে ১৯৯৭ সালে ১.৯ বিলিয়ন টাকায় উপনীত হয়। বাংলাদেশ প্রধানত চামড়ার জুতা রপ্তানি করে এবং রপ্তানির পরিমাণ ১৯৯০-৯১ এবং ১৯৯৬-৯৭ মধ্যকার সময়ে ৫২৭% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতি এবং ফ্যাশনের পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী জুতার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ বিদেশ থেকে জুতা আমদানি করছে এবং এ হার ক্রমবর্ধমানশীল।
উৎপাদনের পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে জুতার বিশ্ব বাজারে ৮ম স্থান দখল করে আছে। এ ছাড়াও অভ্যন্তরীন জুতার বাজারের বাৎসরিক চাহিদার পরিমান ৩০ মিলিয়ন জোড়া যা মধ্যবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে দ্রুত বর্ধনশীল। বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য এবং জুতা উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক সমিতির তথ্যমতে, স্থানীয় জুতা শিল্প বাৎসরিক ২১% হারে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-র মতে দেশের জুতা রপ্তানির পরিমান ২০০৮-০৯ সময়কালে ৬১ মিলিয়ন ডলার থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যার প্রবৃদ্ধির হার ৩৯ শতাংশ।
রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি এ শিল্পের অগ্রগতির সম্ভাবনা নি:সন্দেহে উজ্জল। বর্তমানে জুতা শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার আয়তন প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার হিসাব করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ জুতার চাহিদার এ পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ২০০-২৫০ মিলিয়ন জোড়ার সমপরিমান; যার প্রায় ২৪ মিলিয়ন জোড়া ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬০৭.৮৮ মিলিয়ন ডলারের চামড়াজাত এবং ২৭১.৫৩ মিলিয়ন ডলারের চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি করেছিল। ২০১৭ অর্থবছরে জুতার বিশ্ব বাজারকে ২৪৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যায়ন করা হয়েছিল এবং ২০২১ সালে ৩২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি নতুন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমান ভৌগলিক ও পরিবেশগত সক্ষমতার জন্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা তাদের চামড়া শিল্প কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তরের জন্য উৎসাহী হয়েছে। অতি সম্প্রতি তাইওয়ানের তিনজন বৃহৎ বিনিয়োগকারী ঢাকা ও চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চলের বাইরে বর্তমানে ১৮টি জুতা এবং চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোরিয়ার ইয়ং ওয়ানস্ কোম্পানি বাংলাদেশে এশিয়ার সর্ববৃহৎ জুতা কমপ্লেক্স-এর নির্মাণ কাজ করছে। [ইশতিয়াক আহমেদ খান, মো ওয়াহিদুল হাবিব এবং বেলায়েত হোসেন]