পাঠশালা

পাঠশালা  প্রাক-আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। পাঠশালায় জমিদারি হিসাব, মহাজনী হিসাব, ওজন ও পরিমাপ, দলিল এবং পত্রলিখন শেখানো হতো। পাঠশালা সাধারণত একজন শিক্ষক কর্তৃক পরিচালিত হতো। এ শিক্ষককে বলা হতো গুরু, যিনি তাঁর পাঠশালাকে ব্যক্তিগত বিবেচনায় পরিচালনা করতেন। যদিও সামাজিক উদ্যোগ পাঠশালা কদাচিৎ প্রতিষ্ঠিত হতো, তবুও এর ব্যবস্থাপনায় গুরুর প্রাধান্য ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলায় গুরুভিত্তিক পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল আদিকাল থেকেই এবং তা চালু ছিল উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ফলে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা বিলোপ সাধনের শুরু পর্যন্ত।

পাঠশালা খোলা জায়গায় গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠান, যার পেশাগত জিনিসপত্র যেমন স্থায়ী কাঠামো, আসবাবপত্র এবং কর্মচারীবৃন্দ থাকত না। এ পাঠশালার কোনো নাম থাকত না। এটি সাধারণত যে গুরু পরিচালনা করতেন তাঁর নামেই সমাজের লোকের কাছে পরিচিত হতো। ছাত্ররা মাটিতে বসত। তবে অনেকে বসার জন্য বাড়ি থেকে ছোট আকারের বেতের মাদুর, বাঁশের চাটাই, গাছের ছাল, পাতা প্রভৃতি ইচ্ছামত নিয়ে আসতে পারত।

অপরপক্ষে গুরু তাঁর বাড়ি থেকে আনা একটি চৌকিতে উপবেশন করে তার সম্মান ও ছাত্রদের থেকে পার্থক্য বজায় রাখতেন। যেহেতু গুরু নিজের উদ্যোগে এককভাবে পাঠশালা পরিচালনা করতেন, সেহেতু তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য অনুযায়ী ছাত্র ভর্তি করতেন। গুরুদের অধিকাংশ আসতেন হিন্দুদের কায়স্থ বর্ণ থেকে, যারা সামাজিকভাবে শিক্ষাদান, দেশের কাজ এবং ব্যবসা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। পাঠশালা সব ধর্ম ও বর্ণের ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত ছিল, তবে পাঠশালায় প্রধানত হিন্দু ছাত্র এবং মুসলিম ছাত্ররা যেত।

ঐতিহ্যগতভাবে ছাত্রদের অভিভাবকদের স্বতঃপ্রবৃত্ত চাঁদা এবং লোকহিতেষী পাড়াপড়শিদের দানে পাঠশালার ব্যয় নির্বাহ হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকের একটি সংগৃহীত জরিপে দেখা যায় যে, একজন গুরুর মাসিক আয় স্থান বিশেষে ভিন্ন হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ আয় ছিল গড়ে পাঁচ থেকে বারো টাকা। এটি ছিল সে সময়ের জন্য অতি সম্মানজনক  আয়- এ কারণে যে  এ অর্থ দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে গ্রামীণ এলাকায় দু থেকে তিনি মণ চাল ক্রয় করা যেত। এর বেশি বেতন কদাচিৎই একজন সমযোগ্যতা সম্পন্ন সরকারি কর্মচারি বা জমিদারি কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী পেত।

পাঠশালা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল পঠন, লিখন, পাটিগণিত, পত্রলিখন, প্রাথমিক সংস্কৃত ব্যাকরণ, ধর্মীয় কাহিনী, জমিদারি, মহাজনী এবং ব্যবসা-সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ। ছাত্ররা কেবল গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা পেত না, মনোনীত বয়ঃজ্যেষ্ঠ ছাত্রদের কাছ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করত। পাঠশালার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এদেরকে বেশ সুবিধাদি দেওয়া হতো। তাদেরকে ‘সরদার পোদো’ বলা হতো। সবাই নিয়মিত পাঠশালায় উপস্থিত হতো কিনা গুরু তা নজর রাখতেন। শৃঙ্খলা রক্ষার্থে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা ছাত্রদেরকে বাড়িতে থেকে ধরে আনার জন্য সরদার পোদোদেরকে পাঠানো হতো। এ ছাত্রদেরকে অনুপস্থিতির কারণে নিয়মমাফিক কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। যখন স্বাভাবিক কথা ও সতর্ককরণ উপদেশাদি ব্যর্থ হতো, তখন গুরু এবং সরদার পোদোরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কঠিন শাস্তি প্রদান করতো। ছাত্ররা সাধারণত পাঁচ বছর বয়স থেকে পাঠশালায় প্রবেশ করত এবং পাঠশালার পাঠ্যবিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য সেখানে ছয় থেকে নয় বছর পর্যন্ত অধ্যয়ন করত। দুটি পর্বে পাঠ দেওয়া হতো। প্রথমটি সকালে, দ্বিতীয়টি অপরাহ্নে। ছাত্রদের পড়ার জন্য নির্ধারিত কোনো বই ব্যবহূত হতো না। ফলে শিক্ষা বিস্তারের কাজটি মৌখিকভাবেই পরিবেশিত হতো। গুরু কোনো একটি পাঠ উচ্চস্বরে বলতেন আর ছাত্ররা সেটি সমবেতস্বরে পুনরাবৃত্তি করত। সরদার পোদোর গুরুর হয়ে এ কাজ করত আর সে সময়  গুরু শুধু বেত হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন। ছাত্ররা শুরুতে বালুর উপরে লেখা শিখত। পরে তালপাতায়, এরআগে কলাপাতায়। সর্বোচ্চ স্তরের ছাত্ররা লিখত কাগজে। পাঠশালার শিক্ষাপর্ব শেষ করার পর কোনো সনদপত্র দেওয়া হতো না। যে যার পাঠশালা থেকে পাঠ সমাপ্ত করত, সেটাই হতো তার ছাত্রত্ব অর্জনের সাময়িক স্বীকৃতি। পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছে, যখন চিরায়ত পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণে ক্রমবর্ধনমান চাপের সম্মুখীন হতে থাকে।

পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। যাহোক ১৮৫৪ সালের ‘উডস শিক্ষা রিপোর্ট’ অনুসারে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। পরে বঙ্গীয় সরকার ক্রমান্বয়ে পাঠশালায় প্রদত্ত শিক্ষার মান সম্পর্কে সচেতন হয় এবং পাঠশালার উপর সরকারের বিস্তৃত নিয়ন্ত্রণের পথ ও উপায় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। যেসব পাঠশালার গুরু তাদের পাঠশালায় সরকারি সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণে রাজি হতেন, তারা সরকারি সাহায্য-মঞ্জুরি পেতেন। এ সময় থেকে পাঠশালাগুলি ছাপানো বই, ব্লাকবোর্ড, হাজিরা খাতা, ক্লাসরুম ব্যবহার করে এবং রুটিন, বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে। যেসব পাঠশালা প্রাথমিক শিক্ষার সরকারি নিয়মানুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত, সে পাঠশালার মনোনীত ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান করা হতো। সংস্কারকৃত পাঠশালাগুলি স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও সাহায্য গ্রহণ করত। তবে অনেক পাঠশালা ছিল, যেগুলি সরকারের হস্তক্ষেপ গ্রহণ না করে ঐতিহ্যগতভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেত। তবে ধনী অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে প্রচলিত পাঠশালাগুলির চেয়ে সংস্কারকৃত বিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে অধিক আগ্রহ দেখাত। এর কারণ এই যে, এ নতুন শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চতর শিক্ষা, চাকরির ব্যবস্থা, ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠা এবং কোর্টে আইন ব্যবসার ভালো সুযোগ সৃষ্টি করতো। যেসব ছাত্র নতুন শিক্ষা গ্রহণ করত তারা সমাজের উঁচু মহলে নিজেকে উন্নীত করতে পারত, অন্যদিকে সাধারণ পাঠশালায় শিক্ষিত ছাত্ররা কদাচিৎ উঁচুতলার সামাজিক গতিশীলতায় যোগ দিতে পারত। এ পরিস্থিতিতে এরকম অবস্থা দাঁড়ায় যে, দরিদ্র এবং সংরক্ষণশীল পরিবারগুলি তাদের ছেলেমেয়েদেরকে প্রচলিত সস্তা এবং এমনকি বিনা পয়সায় পড়ানোর জন্য পাঠশালায় প্রেরণের প্রবণতা দেখা যায়, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ধনী ও উদার পরিবারগুলি তাদের ছেলেমেয়েদেরকে সাহায্যপ্রাপ্ত পাঠশালায় পাঠাত, যেখানে নির্ধারিত সরকারি পাঠ্যক্রম অনুসারে শিক্ষা দেওয়া হতো। এভাবে সরকারি পাঠশালাগুলি ক্রমান্বয়ে আধুনিক বিদ্যালয়ের রূপ লাভ করে, অপরদিকে ঐতিহ্যবাহী পাঠশালাগুলি অবশেষে বিলীন হতে থাকে। [কাজী শহীদুল্লাহ]