পলিয়া
পলিয়া বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলসহ রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলায় বসবাসরত একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি। পলিয়ারা বিশ্বাস করে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসার জন্যে এদের পরিচিতি হয় পলিয়া। তাঁরা নিজেদেরকে ক্ষত্রিয় বলে দাবি করেন। ধর্মের দিক থেকে এরা হিন্দু ধর্মের অনুসারী। পলিয়াদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অধিকারী পলিয়া’রা দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালোবাসে। তাদের সমাজে একক ও যৌথ পরিবার লক্ষণীয়। সমাজ প্রধানকে ‘পরামানিক’ বলে। ‘মহত’ হলো গ্রাম প্রধান। পূর্ব থেকে ‘মহত’ মন্ডল বংশের থেকে হয়। অতীতের ন্যায় সমাজে এখন আর ‘মহত’-এর তেমন গুরুত্ব নেই।
পলিয়া সমাজে আন্তঃসম্পর্কিত বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় না। বর্তমানে দু’পুরুষের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে দেখা যায়। বিয়েতে জ্যেষ্ঠতার রীতি মেনে চলা হয়। বিয়েতে অভিভাবকের মতামতই প্রধান। তবে এ অবস্থা এখন অনেকটা শিথিল হয়ে আসছে। বিয়ে ঠিক হলে হলুদ ছোয়ানো টাকা দিয়ে মেয়েকে আশির্বাদ করা হয়। অতীতে কনেপণের প্রচলন থাকলেও ইদানিং যৌতুকের প্রচলন দেখা যায়। পলিয়া সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদ এর প্রচলন রয়েছে। দ্বিতীয় বিবাহও প্রচলিত। পুরুষেরা একাধিক বিয়ে করতে পারেন। মেয়েরা অত্যন্ত কর্মঠ। পুরুষকে প্রায় কাজে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষেরা সম্পত্তির অধিকারী। পলিয়াদের একটি বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ির নৈকট্য বজায় থাকে। এই নৈকট্য স্থানীয় আত্মীয় দলগুলির মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে।
পলিয়া নারীরা এখন শাড়ি পরতে অভ্যস্ত। অতীতে তারা পাড় দেওয়া শাদা শাড়ি পরিধান করলেও ইদানিং বিভিন্ন ধরনের প্রিন্টের শাড়ি পরিধান করেন। পুরুষেরা অতীতে ধুতি পরিধান করলেও এর প্রচলন দিনে দিনে কমে আসছে এবং বর্তমানে তারা গেঞ্জি, সার্ট, লুঙ্গি পরিধানে অভ্যস্ত হচ্ছে। পলিয়া নারীরা অলঙ্কারপ্রিয়। নিজেদেরকে বিচিত্র ধরনের অলঙ্কারে সাজাতে পছন্দ করে। মহিলারা নাকে নোলক, গলায় হার, তাবিজের মালা, কোমরে বিছা ও খোঁপায় বিভিন্ন ধরনের কাটা পরতো।
পলিয়া সমাজে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। সমাজে সন্তানের আগমনকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। প্রসূতিকে পরিচর্যার জন্যে ‘দাইমা'কে প্রসূতির সঙ্গে রাখা হয়। তিনি প্রসূতি পূর্ব থেকে সন্তানের জন্মগ্রহণ পর্যন্ত সহায়তা করেন। সাধারণত বেদে সম্প্রদায় থেকে ‘দাইমা’ রাখা হয়। অন্নপ্রশনের দিন শিশুর নাম রাখা হয়। সন্তান বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধর্মীয় আচারাদি পালন করা হয়।
মৃত ব্যক্তিকে দাহ করা হয়। সঙ্গতি না থাকলে মাটিচাপা দেয়ার প্রবণতাও রয়েছে। মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। দাহ-এর পর আত্মার শান্তির জন্যে উত্তরাধিকারীরা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করেন।
ধর্মীয় আচারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পূজার্চনা। দূর্গাপূজা পলিয়াদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এ ছাড়াও কালী পূজা, মানত পূজা, সূর্য পূজা ও শিব পূজার প্রচলন রয়েছে। এরা সাধারণত ঘট বসিয়ে পূজা সমাপন করেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে শিব ও চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। [মো আব্দুল বাতেন]