পলল

পলল (Alluvium)  ঝুরঝুরে, অসংহত, ঢিলা বা আলগা পদার্থ যা নদী দ্বারা বাহিত হয়ে নদীর তলদেশ, প্লাবনভূমি, বদ্বীপ, খাড়ি বা হ্রদে সঞ্চিত হয়। পলি বা পলল বোল্ডার, কোবল, কাঁকর, বালি, পলিকণা এবং কাদা দিয়ে গঠিত। পললে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জৈব পদার্থ উপস্থিত থাকে যা একে উর্বর মাটিতে পরিণত করে। ‘পলল’ শব্দটি সাধারণত অশিলাকৃত, পৃথক আকৃতির সূক্ষ্ম নদীজ অবক্ষেপের (বালি, পলিকণা এবং কাদা) মধ্যেই সীমিত। খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ হওয়ার সুবাদে পলিমাটি খুবই উর্বর এবং চাষাবাদের জন্য অত্যধিক সুবিধাজনক। পললের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে- এর স্তরবিন্যাস, শ্রেণিবিভাজন এবং গঠন। পললের পাললিক গঠন জটিলও হতে পারে এবং বিষয়টি নির্ভর করে নদীর আচরণের ওপর। বিনুনি আকৃতির এবং সর্পিলাকার নদীর পললের মধ্যে প্রায়ই স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যমুনা নদীর পলল মেঘনা নদীর পললের তুলনায় মোটা বালুবিশিষ্ট। আবার, পললের কণার আকৃতি নির্ভর করে তার সরবরাহ উৎস এবং উৎস থেকে কত দূরে পরিবাহিত হয়েছে তার ওপর। নদীর পললভার পানিপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে নদীর নিম্নপ্রবাহে পরিবাহিত হওয়ার সময় পরিবর্তিত ও পৃথকীকৃত হয়ে যায়। এর ফলে নদীর নিম্ন প্রবাহে সূক্ষ্ম পলিকণা এবং উজান প্রবাহে অপেক্ষাকৃত স্থূল পলিকণা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের অধিকাংশই পুরাতন এবং নবীন নদীজ পলল দিয়ে গঠিত। বয়স, কাঠামো এবং খনিজতত্ত্বের দিক থেকে এসকল পলল অসংহত ও অসম প্রকৃতির এবং বিভিন্ন পরিবেশ, যেমন- মোহনা, জোয়ারভাটা প্রভাবিত এলাকা, পাহাড়ের পাদদেশ এবং নদীবাঁক প্লাবনভূমি প্রভৃতি স্থানে এসব পলল সঞ্চিত হয়েছে। নদীজ প্লাবনভূমি প্রতি বছর নতুন পলি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু নদীর গতিপথের পরিবর্তন হলে প্লাবনভূমি নতুন পলল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের কিছু কিছু প্লাবনভূমিতে বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে খুব সামান্যই পলি সঞ্চয়ন ঘটেছে কিংবা একেবারেই সঞ্চিত হয় নি। নদীগুলো তাদের পুরাতন গতিপথ পরিবর্তন করায় প্লাবনভূমিগুলোর অংশবিশেষ পরিত্যক্ত হয়েছে এবং পুনর্দখলীকৃত হয়েছে। ফলে প্লাবনভূমিসমূহের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন সময়ের পলল যুক্ত হয়েছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীর পলিতে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি নদ-নদীর পলির তুলনায় অভ্রের (mica) উপস্থিতি অনেক বেশি; এখানে সাদা (muscovite) ও গাঢ় বাদামি (biotite) উভয় ধরণের অভ্রই বিদ্যমান। গাঙ্গেয় পলল চুনযুক্ত, তবে অন্য পললে চুনের উপস্থিতি নেই।

সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দিনাজপুর এবং রংপুর জেলার অধিকাংশ পর্বত-পাদদেশীয় পলল বাদামি ও ধূসর এবং অত্যধিক মোটা বালু দিয়ে গঠিত। এই বালুর রং হলদেটে ও বাদামি থেকে ধূসরে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশের সকল নদীর প্রবাহ বরাবর প্রতিনিয়তই নদীপ্রণালিজাত বেলেপাথর ও কাদার অবক্ষেপ গঠিত হচ্ছে; তবে উজানে বালু এবং ভাটিতে কাদার প্রাধান্য রয়েছে। বিশেষ করে, বদ্বীপ অঞ্চলের নদ-নদীগুলি কাদা এবং খুব সূক্ষ্ম বালু সঞ্চিত করে থাকে। পার্বত্য জলপ্রবাহগুলি পার্বত্য অঞ্চল ও এর কাছাকাছি সমভূমি অঞ্চলে বোল্ডার ও নুড়ি সঞ্চিত করে। বঙ্গীয় অববাহিকায় প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণে পলি সঞ্চয়নের ফলাফলস্বরূপ সমস্থিতি ভারসাম্যতা (Isostatic equilibrium) রক্ষার প্রয়োজনে অববাহিকা অবনমন সংঘটিত হচ্ছে। গঙ্গা ও যমুনাসহ কতিপয় নদ-নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কোন কোন নবীন পললভূমিতে চ্যুতি সংঘটিত হয়েছে।  [মোহা. শামসুল আলম]