নীল কমিশন
নীল কমিশন ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলার রায়তদের আন্দোলনের ফলে ১৮৫০-এর দশকের শেষদিকে গঠিত হয়। শুরু থেকেই বাংলায় নীলচাষ নিপীড়ন ও নির্যাতনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। জমির মালিকানা লাভের পর নীলকরেরা নীল চাষে বাধ্য করার জন্য রায়তদের উপর বলপ্রয়োগ করতো এবং নীলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে করবৃদ্ধির হুমকি দিত। শুধু তা-ই নয়, তারা রায়তদেরকে উৎপাদিত নীলের ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত করতো। উনিশ শতকের মধ্যভাগে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে যখন সোনার মূল্য হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে নীলের দাম পড়ে যায়। ফলে রায়তরা নীলচাষ করতে অস্বীকার করে, কিন্তু নীলকরেরা তাদেরকে নীলচাষ অব্যাহত রাখতে বাধ্য করতে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে ১৮৫৯ সালে রায়তরা সমগ্র বাংলা জুড়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে এক সংগঠিত আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের মুখে ১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ সরকার নীল উৎপাদন ব্যবস্থা ও এর অর্থনীতি তদন্ত করবার জন্য ‘নীল কমিশন’ গঠন করে। ডব্লিউ.এস সিটনকার এ কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। কমিশনের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন আর টেম্পল (সরকারি প্রতিনিধি), রেভারেন্ড জে. সেল (খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিনিধি), ডব্লিউ.এফ ফারগুসন (নীলকরদের প্রতিনিধি) ও চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী (জমিদারদের প্রতিনিধি)। ১৫ জন সরকারি চাকুরে, ২১ জন নীলকর, ৮ জন খ্রিস্টান মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৭ জন রায়ত মিলে মোট ১৩৪ জন কমিশনের সামনে তাদের জবানবন্দি প্রদান করেন। ১৮৬০ সালের ১৮ মে থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এ সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
নীলচাষ যে নানাবিধ নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত একথা ‘নীল কমিশনের’ রিপোর্টে প্রথমবারের মতো স্বীকৃত হয়। এ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রায়তদের কিভাবে ঋণ নিতে ও নীলচাষের চুক্তি সই করতে বাধ্য করা হতো; কিভাবে নীলকরেরা অনিচ্ছুক রায়তদের বাড়িঘর লুট করতে ও জ্বালিয়ে দিতে লাঠিয়ালদের ব্যবহার করত; কিভাবে রায়তদের হালের বলদ ধরে নেওয়া হতো; কিভাবে তাদের সবচেয়ে উর্বর জমি নীলচাষের আওতায় আনা হতো। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটরা অত্যাচারী নীলকরদের সাহায্য-সহযোগিতা করত বলে যে অভিযোগ ছিল, তারও সমর্থন মেলে কমিশনের রিপোর্টে।
কমিশন বিধিবহির্ভূত কর্মকান্ডের জন্য ইউরোপীয় নীলকরদের দোষারোপ করলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য তাদের প্রয়োজনের কথাও একই সঙ্গে স্বীকার করে। এর কারণ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীলকরদের উপস্থিতির রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। সংকটকালে নৈরাজ্য দমনে ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে ব্রিটিশ সরকার এদের ব্যবহার করতে পারত। কমিশন রায়তদের উপর নৃশংসতার কথা লিপিবদ্ধ করে বটে, কিন্তু তাদেরকে রক্ষা করার জন্য নতুন আইনের প্রয়োজন বিবেচনা করে নি। বিষয়টি যাতে আরও জটিলাকার ধারণ না করে সে জন্য কমিশন সরকারকে নীলসংকটে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেয়। কমিশন গ্রামাঞ্চলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি সৎ পুলিশবাহিনী ও যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করার প্রস্তাব করে।
নীল-আন্দোলনের তীব্রতা ও ‘নীল কমিশন’-এর রিপোর্ট, সেই সঙ্গে রাসায়নিকভাবে প্রস্ত্তত নীল বাজারে আসার প্রভাবে বাংলায় নীল চাষ ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায়। [নূরুল হোসেন চৌধুরী]
আরও দেখুন নীল প্রতিরোধ আন্দোলন।