নিউকিয়ার চিকিৎসা
নিউক্লিয়ার চিকিৎসা (Nuclear medicine) রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা ও গবেষণায় তেজস্ক্রিয় দ্রব্যের ব্যবহারনির্ভর চিকিৎসাবিদ্যার একটি শাখা। কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত্রুটিনির্ণয়ে রঞ্জনরশ্মি বা এক্সরের মতো আয়নিত বিকিরণ অনেক আগে থেকেই ব্যবহূত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে বাইরের উৎস, যেমন এক্সরে মেশিন থেকে বিকিরণ শক্তি ব্যবহার এবং ফটোগ্রাফিক ফিল্মে ওঠা চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়। এটি হলো রঞ্জনতত্ত্ব (radiology)। পক্ষান্তরে, নিউক্লিয়ার চিকিৎসায় মানুষের শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেজস্ক্রিয় আইসোটোপগুলিই কেবল ব্যবহূত হয়ে থাকে। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ রোগনির্ণয়ের বা চিকিৎসার জন্য শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। নিউক্লিয়ার চিকিৎসার প্রযুক্তি তাই রঞ্জনতত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অবশ্য চিত্র-বিশ্লেষণ নিউক্লিয়ার চিকিৎসারও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রোগনির্ণয়ের বিপরীতে চিকিৎসায়, যেমন ক্যানসার চিকিৎসায়, বিকিরণ ব্যবহার বস্ত্তত নিউক্লিয়ার চিকিৎসারই আওতাভুক্ত।
নিউক্লিয়ার চিকিৎসার আরেকটি পরিচিত উদাহরণ গলগ্রন্থির (thyroid) ত্রুটি শনাক্তি ও চিকিৎসায় তেজস্ক্রিয় আয়োডিন (I131) প্রয়োগ। গলায় অবস্থিত গলগ্রন্থিই আয়োডিন বিপাকক্রিয়ার কেন্দ্র। গলগ্রন্থি কর্তৃক আয়োডিন গ্রহণের মাত্রাই এই গ্রন্থির কর্মক্রিয়ার পরিমাপক। রোগীকে সামান্য মাত্রায় তেজস্ক্রিয় আয়োডিন খাইয়ে গলগ্রন্থিতে সেটি জমার মাত্রা নিণ©র্য়র মাধ্যমেই কাজটি নিষ্পন্ন হয়। অতিসক্রিয় গলগ্রন্থির চিকিৎসায় বেশি মাত্রায় তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ব্যবহূত হতে পারে। এতে তেজস্ক্রিয় আয়োডিনের পরমাণু থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা গ্রন্থিটির একাংশ বিকল করে দিলে গলগ্রন্থির অতিসক্রিয়তার লক্ষণগুলির বেশির ভাগই লোপ পায়। রোগীর শরীরে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ঢুকানোর পর এখন লক্ষ্যস্থিত অঙ্গের প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুট করার জন্য সূক্ষ্ম ও জটিল কম্পিউটার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় এবং পর্যবেক্ষক উপযুক্ত কম্পিউটার সফ্ওয়্যারের সাহায্যে তৎক্ষণাৎ কালানুক্রমিক ক্রিয়াকর্মের চিত্রাঙ্কলেখ (curve) পেয়ে যান।
বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার চিকিৎসার শুরু ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ১৯৬১ সাল থেকেই দেশে গলগন্ড ও গলগ্রন্থির অন্যান্য রোগে নিউক্লিয়ার চিকিৎসা প্রযুক্তি ব্যবহূত হয়ে আসছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিউক্লিয়ার চিকিৎসা ইনস্টিটিউট এবং ১৩টি সরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ১৩টি নিউক্লিয়ার চিকিৎসা কেন্দ্র আছে। নিউক্লিয়ার চিকিৎসার প্রযুক্তি যথেষ্ট জটিল এবং তাতে চিকিৎসক ছাড়াও পরমাণু পদার্থবিদ, ইলেকট্রনিক প্রকৌশলী, রসায়নবিদ ও প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ জড়িত থাকায় এক্ষেত্রে যাথাযথ সরকারি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। বাংলাদেশ একটি আয়োডিনঘাটতির অঞ্চল এবং লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কোন না কোন উপায়ে আয়োডিন ঘাটতি বা গলগ্রন্থির ত্রুটিজনিত রোগে আক্রান্ত। তাই নিউক্লিয়ার চিকিৎসা এক্ষেত্রে একদিন নিশ্চিতই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার একটি প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠবে। ঢাকায় বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের Institute of Nuclear Medicine - সহ দেশের বিভিন্ন নিউক্লিয়ার চিকিৎসা কেন্দ্রে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ I131 এবং TC99mMDP এই দুটিই সাধারণত চিকিৎসা গবেষণা ও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহূত হয়। [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]