নাটোর রাজবাড়ি
নাটোর রাজবাড়ি রাজশাহী থেকে প্রায় ৪৮ কিমি পূর্বে নাটোর জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাটোর রাজদের বাসভবন। আঠারো শতকের প্রথম দিকে এটি নির্মিত হয়। মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের অন্যান্য সামন্ত প্রাসাদের মতোই নাটোর রাজবাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে দীর্ঘ পথ, যার দুপাশে অত্যন্ত যত্নে গড়ে তোলা বোতল পামের (bottle palm) সারি বিদ্যমান। নাটোর রাজপরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন নাটোরেই স্থাপন করেছিলেন তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং সেই সাথে নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দিঘি, মন্দির এবং ফল ও ফুলের বাগান। ইতিপূর্বে নাটোর ছিল লস্করপুর পরগণার অন্তর্গত কানাইখালি তরফ-এ একটি ছোট বসতি। প্রায় ৩৭.২০ একর জমির উপর নির্মিত বর্তমান প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি দুটি প্রতিরক্ষা পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পরিখাটি ছই ভাঙ্গার বিল নামে পরিচিত ছিল। ভগ্ন প্রাসাদের বিচ্ছিন্ন সাতটি ব্লককে বেষ্টনকারী কাদা ও আগাছা আচ্ছাদিত দিঘি সেই পরিখার চিহ্ন বহন করছে। পরবর্তীকালে রানী ভবানী কমপ্লেক্সটির উন্নয়নে ও বৃদ্ধিতে যথেষ্ট অবদান রাখেন।
সাতটি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটিকে মোটামুটি সংস্কার করে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অফিস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। আর বাকিগুলি আকারহীন বিচ্ছিন্ন কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। একতলা বিশিষ্ট উত্তর ব্লকটি বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে ডেপুটি কমিশনারের অফিস হিসেবে। এর ঠিক সামনে অর্থাৎ দক্ষিণে রয়েছে একটি বেশ বড় উন্মুক্ত লন। এ লনের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আকৃতিতে দুটি ব্লক, যেগুলির পূর্ব পার্শ্বে রয়েছে ফাঁকা জায়গা। উত্তরের প্রধান ব্লকটির সম্মুখভাগ প্রায় ৩০.৪৮ মিটার বিশিষ্ট। এর ঠিক মাঝামাঝিতে রয়েছে একটি লক্ষণীয়ভাবে অভিক্ষিপ্ত পোর্চ, আর দুপ্রান্তে রয়েছে সামান্য বর্ধিত দুটি ‘বে’ এবং এদের উপরে আছে ত্রিভুজাকৃতির পেডিমেন্ট।
জাঁকালো কেন্দ্রীয় পোর্চ ও সামনের বারান্দার ভার বহন করছে সারিবদ্ধভাবে স্থাপিত সেমি-কোরেনথিয়ান রীতিতে তৈরি স্তম্ভ ও ক্লাসিক্যাল রোমান ফ্যাশনে ভাগ ভাগ করে নির্মিত বিচ্ছিন্ন খিলানসমূহ। এ ব্লকে রয়েছে ঠিক কেন্দ্রে স্থাপিত একটি বিশাল অভ্যর্থনা হল ও একে ঘিরে এগারোটি বৃহৎ কক্ষ। কেন্দ্রীয় হলটির (১৮.২৯ মি × ৯.১৪ মি) সিলিং ৯.১৪ মিটার উঁচু এবং হলে আলো প্রবেশ করার জন্য রয়েছে রঙিন কাঁচের গ্লাসে নির্মিত দেওয়ালের উপরের দিকে স্থাপিত ছাদসংলগ্ন ১৮টি জানালা (clerestory)। কিছু কিছু স্তম্ভের শীর্ষে শোভাবর্ধক হিসেবে রয়েছে ক্লাসিক্যাল নগ্ন নারী ভাস্কর্য।
পশ্চিমের ৬০.৯৬ মিটার দীর্ঘ এক তলা ব্লকটিও কেন্দ্রে খিলান বিশিষ্ট অভিক্ষিপ্ত ‘বে’ সমৃদ্ধ। সামনের খোলা বারান্দাটির সমস্তটি জুড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ ডোরিক রীতির স্তম্ভ। ব্লকটির পেছনে রয়েছে একটি নাট-মন্ডপ (নাচ ঘর) এবং তারও পেছনে আরও পশ্চিমে আছে একটি কৃষ্ণ মন্দির। এ পারিবারিক মন্দিরটি প্রায় ১৫.২৪ মিটার প্রশস্ত। মন্দিরটিতে রয়েছে ডাবল কোরিনথিয়ান স্তম্ভের সারি ও পেছনে রয়েছে ৩.০৫ মিটার প্রশস্ত বারান্দা। এ ব্লকের ঠিক সমকোণে নির্মিত হয়েছে উত্তরমুখী আর একটি এক তলা বিল্ডিং যার সম্মুখভাগ ৪৫.৭২ মিটার প্রশস্ত। অভিক্ষিপ্ত কেন্দ্রীয় পোর্চ ও তদ্সংলগ্ন বারান্দা এবং এগুলির পেছনে রয়েছে সারিবদ্ধ কক্ষ। ব্লকটির পাশেই রয়েছে একটি আগাছাচ্ছন্ন দিঘি। ব্লকটির পশ্চাৎ ভাগ প্লাস্টারের সাহায্যে তৈরি নকশায় অলংকৃত। বর্তমানে এ ভবন পুলিশের সুপারিনটেন্ডেন্ট-এর অফিস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঐ একই দিঘির পাশেই দৈব্যক্রমে টিকে আছে আরও দুটি ভবন। এদের মধ্যে ছোটটি ১৫.২৪ মিটার চওড়া। এর বারান্দায় রয়েছে সারিবদ্ধ ডোরিক রীতির জোড়া স্তম্ভ। বড়টি ৩০.৪৮ মিটার প্রশস্ত এবং এর বারান্দাটি দাঁড়িয়ে আছে সেমি-কোরিনথিয়ান স্তম্ভের উপর। দুটি ভবনই এখন ঘনঝোপ ও ধ্বংসাবশেষে ঢাকা।
তবে পরিত্যক্ত দিঘিটির পশ্চিম পাড়ে চিত্রের ন্যায় উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছোট-তরফ ভবনের মূল ব্লকটি একটি মনোরম ভবন যা বর্তমানে জেলা জজ কোর্ট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। ২১.৩৪ মিটার ফাসাদের ভবনটিতে রয়েছে তিনটি খিলানবিশিষ্ট একটি অভিক্ষিপ্ত বর্ধিত বারান্দা (portico)। ভবন কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশাল অভ্যর্থনা হল যা পার্শতবর্তী অন্যান্য অংশ থেকে উঁচু। এর শীর্ষে রয়েছে পিরামিডাকৃতির ছাদ এবং আলো প্রবেশের জন্য ছাদসংলগ্ন জানালা। পোর্চের প্যারাপেটকে অলংকৃত করা হয়েছে প্লাস্টারের সাহায্যে ফুলেল লতাপাতা ও নব-যুগীয় ভাস্কর্যের মিশেলে ফ্রিজ নকশায়। ভবনের দুপ্রান্তে রয়েছে দুটি ছোট অভিক্ষেপের বর্ধিত ‘বে’। এগুলি আবার অলংকৃত হয়েছে দুজোড়া কোরিনথিয়ান স্তম্ভ ও উপরে দেওয়ালের ত্রিভুজাকৃতি অংশ দ্বারা। এ ভবনে রয়েছে দুটি বিশাল হল ঘরসহ মোট পনেরোটি কক্ষ। হল ঘরগুলি একটির পর আর একটি স্থাপিত। ভবনের একেবারে পেছনের দিকে রয়েছে একটি ব্যালকনি, যা একটি পরিখার কোল ঘেঁষে অবস্থিত। ব্লকটির পেছনের অংশ সজ্জিত হয়েছে আয়োনিক স্তম্ভ শীর্ষ, ফুলেল মোটিফ ও শ্মশ্রুমন্ডিত মানুষের মুখের স্টাকো (stucco) সহযোগে। [নাজিমউদ্দীন আহমেদ]
গ্রন্থপঞ্জি Kishori Chand Mitra, ‘The Rajas of Rajshahi’, The Calcutta Review, LVI, 1873; Aksaykumar Maitreya, ‘Rani Bhavani’ in Sahitya, Sravan 1304 bs; কালীনাথ চৌধুরী, রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কলকাতা, ১৩০৮; Bangladesh District Gazetteers, Rajshahi, 1976; Nazimuddin Ahmed, Building of the British Raj in Bangladesh, UPL, 1986; মোঃ মাহবুবুর রহমান, ‘বরেন্দ্রের রাজা ও জমিদার’, বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস, রাজশাহী, ১৯৯৮।