নড়াইল জেলা

নড়াইল জেলা (খুলনা বিভাগ) আয়তন: ৯৬৭.৯৯ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৩°০২´ থেকে ২৩°১৯´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°২৩´ থেকে ৮৯°৪৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে মাগুরা জেলা, দক্ষিণে খুলনা ও বাগেরহাট জেলা, পূর্বে ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে যশোর জেলা।

জনসংখ্যা ৭২১৬৬৮; পুরুষ ৩৫৩৫২৭, মহিলা ৩৬৮১৪১। মুসলিম ৫৮৬৫৮৮, হিন্দু ১৩৪৫৯৪, বৌদ্ধ ৬, খ্রিস্টান ২৫৮ এবং অন্যান্য ২২২।

জলাশয় প্রধান নদী: মধুমতি, চিত্রা, নবগঙ্গা, ভৈরব।

প্রশাসন ১৯৮৪ সালে নড়াইল জেলা গঠিত হয়। জেলার তিনটি উপজেলার মধ্যে নড়াইল সদর উপজেলা সর্ববৃহৎ (৩৮১.৭৫  বর্গ কিমি)। জেলার সবচেয়ে ছোট উপজেলা লোহাগড়া (২৮৪.৯১ বর্গ কিমি)। জেলা শহর চিত্রা নদীর তীরে অবস্থিত।

জেলা
আয়তন (বর্গ কিমি) উপজেলা পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব(প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
শহর গ্রাম
৯৬৭.৯৯ ৩৮ ৪১০ ৬৩৫ ১১২৩৫২ ৬০৯৩১৬ ৭৪৬ ৬১.৩
জেলার অন্যান্য তথ্য
উপজেলা নাম আয়তন(বর্গ কিমি) পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
কালিয়া ৩০১.৩২ ১৩ ১১০ ১৮৭ ২২০২০২ ৭৩১ ৫৫.৩
নড়াইল সদর ৩৮১.৭৫ ১৩ ১৬২ ২৩১ ২৭২৮৭২ ৭১৫ ৬৫.৫
লোহাগড়া ২৮৪.৯১ ১২ ১৩৪ ২১৭ ২২৮৫৯৪ ৮০২ ৬১.৯

সূত্র আদমশুমারি রিপোর্ট ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদ গোয়ালবাথান মসজিদ, উজিরপুরে রাজা কেশবরায়ের বাড়ি (নড়াইল সদর), কদমতলা মসজিদ, আরাজী বাঁশগ্রামের ভূগর্ভস্থ প্রাচীন দালান, কালিয়া কলেজে সংরক্ষিত পিতলের রথ, বড়দিয়ার মঠ (কালিয়া), নলদীর গাজীর দরগাহ্, জোড়বাংলা রাধাগোবিন্দ মন্দির, লক্ষ্মীপাশার কালীবাড়ি (লোহাগড়া)।

ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ১৮৫৯ সালে এ জেলায় নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্টকর্মী নূরজালালের নেতৃত্বে সদর উপজেলায় তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ মিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় যুবকরা নড়াইল অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লোহাগড়ায় নিয়ে যায়। ১ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আক্রমণের উদ্দেশ্যে নড়াইল থেকে যশোর সেনানিবাস অভিমুখে যাত্রা করে। ২ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা রূপগঞ্জ পাকসেনা-ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা ৬০ জন পাকসেনাকে ধরে নড়াইল ফেরিঘাটে হত্যা করে। ৩ এপ্রিল পাকসেনারা নড়াইল শহর আক্রমণ করে। ৬ এপ্রিল পাকসেনাদের বিমান আক্রমণে নড়াইল শহরের কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শহর জনশূণ্য হয়ে যায়। ১৩ এপ্রিল পাকসেনারা নড়াইলে ঘাঁটি স্থাপন করে। মে মাসের প্রথমদিকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা রামসিদ্ধি থেকে কালিয়া পাইলট হাই স্কুলের শিক্ষক শেখ আব্দুস ছালামকে ধরে নিয়ে ১৩ মে যশোর সেনানিবাসে হত্যা করে। ২৩ মে পাকসেনারা লোহাগড়া উপজেলার ইতনায় ৩৯ জন নিরীহ লোককে হত্যা, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতন করে। ১৭ জুলাই স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা তুলারামপুর গ্রাম থেকে ৮ জন নিরীহ লোককে ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে। ৭ ডিসেম্বর মাছিমদিয়া গ্রামে পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান শহীদ হন। ৯ ডিসেম্বর পাকসেনাদের ঘাঁটিতে (নড়াইল সদর) মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাÍক আক্রমণ চালায় এবং এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কালিয়া হাই স্কুল ও ডাকবাংলোর পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। ৩ দিন ( ৮-১০ ডিসেম্বর) স্থায়ী এ লড়াইয়ে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৪ জন পাকসেনা ও ৯ জন রাজাকার নিহত হয়। ৮ ডিসেম্বর লোহাগড়া উপজেলা পাকসেনা মুক্ত হয় এবং ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ চালিয়ে নড়াইল শহর পাকসেনা মুক্ত করেন। ১৪ ডিসেম্বর ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর নড়াইল ডাকবাংলোর সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। নড়াইল সদর উপজেলার রূপগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস চত্বর এবং লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে ২টি গণকবর রয়েছে।

শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৬৫.৫%; পুরুষ ৬৮.৪%, মহিলা ৬২.৭%। কলেজ ২২, হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ১, কৃষি ও কারিগরি কলেজ ১, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১,  মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১৫, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৫৮, স্যাটেলাইট স্কুল ২০, কমিউনিটি বিদ্যালয় ৭, এতিমখানা ৭৩, অন্ধস্কুল ১, কিন্ডার গার্টেন ১, মাদ্রাসা ১৯০। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৮৮৬), লক্ষ্মীপাশা আদর্শ বিদ্যালয় (১৮৮৯), লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়, মুন্সি মানিক মিয়া ডিগ্রি কলেজ, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল (১৮৫৭), ইতনা হাই স্কুল এন্ড কলেজ (১৯০০), কালিয়া শহীদ আব্দুস সালাম ডিগ্রি কলেজ (১৯৭২), নড়াইল বালক উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৫৪), ভি.সি উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৫৭), কালিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৬৫), ইতনা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯০০), নড়াইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৩), লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৬), মালিয়াট মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯০৬),  কালিয়া পি.এস পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় (১৯১১), দি পাটনা একাডেমী (১৯১২), হবখালী হামিদুননেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯১৬), নলদী বি. এস. এস উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৬), কাশিপুর এ.সি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৬), কে.ডি.আর.কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯২০), সিঙ্গাশোলপুর কে.পি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯২১), সিঙ্গিয়া-হাটবালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯২১), পার্বতী বিদ্যাপিঠ (১৯২৩), ইতনা মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯৩০) বাড়ৈপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৮৫০), বাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৮৯৫), শাহবাদ মজিদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা (১৯৫০)।

জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৬২.০৮%, অকৃষি শ্রমিক ২.৫১%, শিল্প ১.৪৮%, ব্যবসা ১৩.২০%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ৩.৪৭%, চাকরি ৯.৮৭%, নির্মাণ ১.০০%, ধর্মীয় সেবা ০.২০%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.৮৬% এবং অন্যান্য ৫.৩৪%।

পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী  দৈনিক: ওশান; সাপ্তাহিক: নড়াইল বার্তা; পাক্ষিক: কিরণ, ভোরের আলো (অবলুপ্ত); মাসিক: প্রান্তিক; সাময়িকী: কল্যাণী, বারুজীবী সমাচার, ভাস্কর, গ্রামের বাণী, জাগৃতি, রক্তঋণ, হাতছানি, বিজয়, সাহিত্যকলি, ফেরা, শেকড়ের সন্ধানে, শতাব্দীর আলো।

লোকসংস্কৃতি এ জেলায় জারীগান, কবিগান, কীর্ত্তন, হালুইগান, সারীগান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী প্রভৃতি লোকসঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ, প্রবচন, লোকগাঁথা বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন উৎসবে মেয়েলী গান, অনাবৃষ্টির সময় কাঁদামাটি মেখে মেঘকে আহবান করে গান ও সিরনি বিতরণ, রোগবালাই দূর করার উদ্দেশ্যে আশ্বিন মাসের শেষ দিন ডালাভর্তি ফুলপাতা পানিতে ভাসানো, গো-মড়ক ঠেকাতে সিরনি বিতরণ ইত্যাদি লোকাচার। এছাড়াও নৌকাবাইচ, চিবুড়ি, কুতকুত, এপেন্ডি বায়োস্কোপ, ইচিংবিচিং, বালিহাঁস, কানামাছি, এক্কাদোক্কা ইত্যাদি লোকক্রীড়া উল্লেখযোগ্য।

বিনোদন কেন্দ্র নড়াইল সদর উপজেলার ‘শিশুস্বর্গ’, লোহাগড়া উপজেলার ‘নিরিবিলি’ পিকনিক স্পট এবং শিশুদের জন্য ‘নিরিবিলি’ খামারবাড়ি, কালিয়া উপজেলার ইকোপার্ক ‘অরুণিমা’।  [মো. হামিদুল হক মুন্সী]

আরও দেখুন সংশ্লিষ্ট উপজেলা।

তথ্যসূত্র  আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১ ও ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; নড়াইল জেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭; নড়াইল জেলার উপজেলাসমূহের  সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।