নক্শবন্দিয়া

নক্শবন্দিয়া  (নকশাবন্দিয়া)  তাসাওউফের প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত একটি তরিকা। খাজা বাহাউদ্দীন ইব্ন আহমদ আল-বুখারী (র.) এর প্রতিষ্ঠাতা। ‘নক্শবন্দ’ শব্দের অর্থ ‘চিত্রকর’; এ তরিকার সূফীরা আল্লাহর মহিমার চিত্র হূদয়ে ধারণ করেন এ অর্থে তাঁদের বলা হয় নক্শবন্দী।

নক্শবন্দিয়া তরিকায় আটটি বিশেষ তাসাওউফি পরিভাষা রয়েছে, যেগুলিকে এ তরিকার ভিত্তি মনে করা হয়। পরিভাষাগুলি হলো: ১. হুশ দার দিখ- মনের বিক্ষিপ্ততা প্রতিরোধে নিঃশ্বাস সংযম; ২. নজ্র বর্ কদম- দৃষ্টির বিক্ষিপ্ততা প্রতিরোধে দৃষ্টি সংযম; ৩. সফর দর্ ওয়াতন- মুকিম হয়েও মুসাফির; ৪. খালওয়াত দর্ আঞ্জুমন- সংসারে থেকেও তার প্রতি নির্লিপ্ত; ৫. ইয়াদ কর্দ- সকল অবস্থায় আল্লাহর স্মরণ-জিকিরে আত্মনিয়োগ; ৬. বাস্ গাশ্ত- প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর চিন্তায় নিমগ্ন থাকার প্রক্রিয়া সন্ধান; ৭. নিগাহ্ দাশ্ত- সার্বক্ষণিক আত্মরক্ষার চেষ্টায় অতন্দ্র থাকা এবং ৮. ইয়াদ দাশ্ত- সার্বক্ষণিক আল্লাহর চিন্তায় নিমজ্জিত থাকা।

খাজা বাহাউদ্দীন উপর্যুক্ত বিষয়গুলির সঙ্গে আরও তিনটি বিষয় সংযোজন করেন। সেগুলি হলো: ১. ওয়াকূফ-ই-জামানি- নিজের সময় ও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ; ২. ওয়াকূফ-ই-কালবি- হূদয় নিয়ন্ত্রণ এবং ৩. ওয়াকূফ-ই-‘আদাদি- জিকির ইত্যাদি বেজোড় সংখ্যায় সম্পন্নকরণ। সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজা বাকী বিল্লাহ (মৃত্যু. ১৬০৩) এ তরিকা ভারত উপমহাদেশে নিয়ে আসেন। তাসাওউফের অপর তিনটি প্রাপ্য প্রসিদ্ধ তরিকা  কাদেরিয়া, চিশতিয়া ও  সুহরাওয়ার্দিয়া এর আগেই উপমহাদেশে প্রচারলাভ করে।

নক্শবন্দিয়া তরিকার প্রথম ধারক ও বাহক খাজা বাকী বিল্লাহ তাঁর জীবনের শেষ চার-পাঁচ বছর এ দেশে এর বুনিয়াদকে দৃঢ়রূপে স্থাপন করেন। তবে এটি মূল শক্তি সংগ্রহ করে তাঁর প্রধান মুরিদ হযরত শায়খ আহমাদ সিরহিন্দী-মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানি (র.)-এর মাধ্যমে, যার ফলে তরিকাটি ‘মুজাদ্দিদি তরিকা’ নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করে। হযরত মুজাদ্দিদ আধ্যাত্মিক আমলের বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও ওয়াজিফাকে ভিন্নরূপে বিন্যস্ত করেন। তিনি মানব দেহাভ্যন্তরে ‘ছয় লতিফা’র স্থান নির্ণয় করেন। আকবরের ‘দীন-ই-ইলাহী’র প্রেক্ষাপটে মুজাদ্দিদি তরিকা শরী‘আত, হকীকত ও নবীর সুন্নাতের অনুসরণ এবং চিন্তাজগতে সংস্কার সাধনের চেষ্টা করে। ক্রমে এটি জনপ্রিয় হয়। খাজা মুহাম্মদ মা‘সূম ও অন্যান্য নক্শবন্দী বুজুর্গ খলিফা ও ভক্তের দ্বারা এ তরিকা মধ্য এশিয়া ও আরব দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত উপমহাদেশে এবং মুসলিম বিশ্বের অনেক অঞ্চলে এখনও এ তরিকা বিদ্যমান।  [রুহুল আমিন]