ধানমন্ডি
ধানমন্ডি ঢাকা শহরের একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। সুবা বাংলার অন্যতম রাজধানী নগরী ঢাকা ঔপনিবেশিক আমলে তার গৌরব হারায় এবং কালক্রমে একটি মফস্বল জেলা শহরে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে বাংলার বিভক্তির পর ঢাকাকে পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী করা হয়। নতুন রাজধানীর প্রয়োজনে দপ্তর ও ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। ঢাকা শহরকে একটি পরিকল্পিত মহানগরীতে রূপান্তরের উদ্দেশ্যে ৯৫৬ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৫৯ সালে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
ধানমন্ডিকে একটি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৪৯ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কনস্ট্রাকশান অ্যান্ড বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট কৃষি ও উদ্যান সংশ্লিষ্ট ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে এবং ঐ জমি সমতল করে অনুমোদিত মানদন্ড অনুযায়ী জনসাধারণের মধ্যে প্লট বরাদ্দ করে। পরবর্তীকালে ডিআইটি জনসাধারণের সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি, রাস্তা ও অন্যান্য ভৌতকাঠামো নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। এলাকাটি কয়েকটি ব্লকে বিভক্ত করা হয় এবং পরবর্তীকালে প্রতিটি ব্লককে এক বিঘা অথবা তার কম পরিমাপবিশিষ্ট প্লটে ভাগ করা হয়। এ সকল প্লট মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা, জননেতৃবৃন্দ, ও পেশাজীবীদের বরাদ্দ করা হয় এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যেও কিছু প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করে এর আশেপাশে ও অন্যান্য খোলা স্থানে গাছপালা লাগানো হয়। বিঘাপ্রতি ৫,০০০ টাকা পরিশোধের পর বরাদ্দপ্রাপ্তদের প্লটসমূহ ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদান করা হয়।
ধানমন্ডির প্লটসমূহকে সম্পূর্ণ আবাসিক রাখার এবং কোনো প্লট বা বাড়ি কোনো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার না করার জন্য ডিআইটি-র একটি বিধান ছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালে শহরের জমির উপর প্রচন্ড চাপের মুখে বিধানটির প্রয়োগ শিথিল হয়ে পড়ে। বর্তমানে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় প্রায় অর্ধেক প্লট দোকান, সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, প্রদর্শনী কেন্দ্র ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের গুদাম, এনজিও অফিস, ক্লিনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারখানা হিসেবে নানা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হচ্ছে। ফলত এলাকাটির সামাজিক চরিত্র ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধানমন্ডি এখন একটি বহুমুখী এলাকায় পর্যবসিত। সামাজিকভাবে ধানমন্ডি এলাকার আবাসিক পরিধির তুলনায় অনাবাসিক স্থাপনার পরিধি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এভাবে ধানমন্ডিকে একটি নির্ভেজাল আবাসিক এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের প্রকৃত পরিকল্পনার স্থলে চলমান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
প্রজন্মের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধানমন্ডির প্লটের প্রকৃত মালিকদের অধিকাংশের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকারী এবং ক্রেতাগণ। তাদের অনেকেই দেশের বাইরে অবস্থান করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের জমি হয় ভাড়াটে, নয় ক্রয়সূত্রে নতুন মালিকরা ব্যবহার করছে। তথাপি আবাসিক এলাকার মধ্যে ধানমন্ডির প্রাধান্য বজায় রয়েছে। ধানমন্ডির সড়ক নম্বর ৩২-এ অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বাড়িটিকে জাদুঘরে (বঙ্গবন্ধু জাদুঘর) রূপান্তর করা হয়েছে। বাড়ির সামনের লেকটিকে দখলদারদের হাত থেকে বহুলাংশে উদ্ধার করে পুনঃখনন করা হয়েছে। পথচারীদের জন্য লেকের পাশে বৃক্ষশোভিত পায়ে চলার পথ তৈরি করা হয়েছে। লেক ও সবুজ বৃক্ষরাজি শোভিত রাস্তা, পানির ফোয়ারা এবং জাদুঘরের সামনের চত্বর এখন ধানমন্ডির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক স্থান। [সিরাজুল ইসলাম]