দেবকোট
দেবকোট বানানভেদে দেওকোট অথবা দেবিকোট, পূর্ব ভারতের প্রধান প্রাচীন নগরীগুলির একটি। উমাবন অথবা ঊষাবন, কোটীবর্ষ শোণিতপুর, বানপুর প্রভৃতি নামে এ নগরীর উল্লেখ রয়েছে। ধারণা করা হয়, এগুলি সমার্থক শব্দ। এ নগরীকে লোক-কাহিনীর দানব রাজ বাণ-এর ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী ‘বাণগড়ের’ সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়। যাদব প্রকাশের বৈজয়ন্তী-তে (অনুমানিক খ্রিস্টীয় এগারো শতক) ‘দেবিকোট্ট’ এবং কোটীবর্ষকে একই নগরী হিসেবে বলা হয়েছে। কল্পসূত্র, বিষ্ণু পুরাণ, শ্রীমৎ ভাগবত, বায়ুপুরাণ এবং বৃহৎ সংহিতার মতো প্রাচীন গ্রন্থে কোটিবর্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়। বায়ুপুরাণে একে একটি শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্ত্তত, গুপ্তযুগে কোটীবর্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। গুপ্তরাজাদের ভূমিদানলিপিতে এর উল্লেখ রয়েছে। পুন্ড্রবর্ধনভূক্তির অধীনে এখানে একটি ’বিষয়’এর (জেলা) অধিষ্ঠান (সদর দপ্তর) ছিল। বাংলার পাল বংশের শাসনামলে কোটীবর্ষ জেলা হিসেবে বহাল ছিল। রামচরিতম্ গ্রন্থের লেখক সন্ধ্যাকর নন্দী প্রসঙ্গক্রমে শোণিতপুরকে বরেন্দ্রের একটি সমৃদ্ধিশালী ও জাঁকজকমপূর্ণ নগরী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বাংলার সুলতানি আমলের গোড়ারদিকে রাজ্যের উত্তর সীমান্তে দেবকোট একটি গুরুত্বপূর্ণ চৌকি ছিল। বস্ত্তত, বখতিয়ার খলজী ও পরবর্তী খলজী মালিকদের আমলে দেবকোট বিশিষ্ট নগরীর মর্যাদা লাভ করে। বখতিয়ার খলজী তিববত অভিযানের পূর্বে দেবকোটে রাজধানী স্থাপন করেন এবং তিববত অভিযান হতে ফিরে এসে এখানেই তার মৃত্যু হয় এবং এ স্থানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
দেবকোটে মওলানা শাহ আতা’র সমাধিসৌধের দেয়ালে সংযুক্ত ৬৯৭ হিজরির (১২৯৭ খ্রিস্টাব্দ) একটি লিপি প্রাথমিক যুগের বাংলার সুলতানদের নিকট স্থানটির গুরুত্বের ইঙ্গিত বহন করে। সুলতান কায়কাউসের রাজত্বকালে (আনু. ৬৯১-৭০২ হিজরি) ও প্রাদেশিক গভর্নর জাফর খান বাহরাম আইতগীনের সময়ে মুলতানের সালাহ জিওয়ান্দের তত্ত্বাবধানে একটি মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে লিপিটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। ঘটনাক্রমে সিকান্দর শাহ (১৩৫৮-৯২ খ্রি.), মুজাফফর শাহ (১৪৯০-৯৩ খ্রি.) ও হোসেন শাহ এর (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি.) রাজত্বকালের কমপক্ষে আরও তিনটি লিপি উক্ত সমাধিসৌধের দেয়ালে সংযুক্ত করা হয়েছে। যদিও এগুলিতে শাহ আতা’র নাম উল্লেখ নেই। কিন্তু এ সব লিপি থেকে স্থানটির গুরুত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বুকাননের বর্ণনানুসারে সমাধিসৌধের দেয়ালে একটি শূন্য প্যানেল রয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দেয়ালে একটি ৫ম লিপিও ছিল। কিন্তু এখনও এর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।
বুকানন হ্যামিলটন প্রায় দেড় শতক আগে স্থানটি পরিদর্শন করে এর একটি চমৎকার বিবরণ রেখে গেছেন যা ধ্বংসপ্রাপ্ত বানগড়/ দেবকোট সম্পর্কে জানার বিষয়ে সম্ভবত অধিক প্রাসঙ্গিক। তাঁর বর্ণনা অনুসারে, ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘বাণ্ণোগড়’ পুনর্ভবা নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত। পুনর্ভবা ‘দুমদুমাহ’র সামান্য ঊর্ধ্বভাগ হতে শুরু হয়ে উত্তর-পূর্ব দিক হতে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৩.২১ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। তিনি প্রথমে নগর দুর্গটি পরীক্ষা করেন। এটি প্রায় ৫৪৯ মিটার দীর্ঘ ও প্রায় ৪৫৭ মিটার চওড়া। ইটের উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এ দুর্গের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে পরিখা ছিল। পরিখার অবশিষ্টাংশ পুনর্ভবা নদী দ্বারা বিলুপ্ত। পুনর্ভবা ব্রাহ্মণীর বর্তমান গতিপথের উত্তর দিয়ে প্রবাহিত হতো বলে মনে করা হয়। বানগড় খননের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ববিদ কে.জি গোস্বামী বলেন যে, বানগড় ধ্বংসাবশেষের উত্তর-পশ্চিমে পুনর্ভবা নদীর অপর পাড়ে ঊষাগড় নামে পরিচিত একটি ছোট ঢিবি রয়েছে। বাণ-এর কন্যা ‘উষা’র নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল।
কোন কোনো পন্ডিত মনে করেন, বুকানন দেবকোট হতে ৪.৮ কিলোমিটার দক্ষিণে গঙ্গারামপুর-এর সঙ্গে দেবকোটকে এক করে ফেলেছেন। দেবকোটের যথার্থ অবস্থান সম্পর্কিত অস্পষ্টতা পরিহার করার জন্য কানিংহামের প্রতিবেদনটি বিবেচনা করা যায়। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠালগ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবকোটের সঠিক বিবরণ কানিংহাম দিয়েছেন। তাঁর মতে দেবকোটের পুরাতন দুর্গটি পুনর্ভবা নদীর বামদিকে অর্থাৎ পূর্বতীরে পান্ডুয়া হতে ৫৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে, দিনাজপুর হতে ২৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং গৌড় দুর্গের ১১৩ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপূর্বে অবস্থিত। দেবকোটের উত্তরে প্রায় একই আয়তনের দেয়াল ঘেরা আর একটি এলাকা রয়েছে। উভয় এলাকাই প্রকান্ড মাটির গড় ও প্রশস্ত পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। দক্ষিণ দিকে ছিল দমদমার মুসলিম আবাসিক এলাকা। এ স্থান হতে একটি বেড়িবাঁধ দহলদিঘি ও কালাদিঘি নামক দুটি বৃহৎ জলাশয় অতিক্রম করে পূর্বদিকে প্রলম্বিত ছিল। [ইছামুদ্দিন সরকার]