দুর্গাপূজা
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে। যেমন কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে দেবীর পূজা ও উৎসব পালিত হয়।
দুর্গা পৌরাণিক দেবতা। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে তাঁর নাম হয় দুর্গা। জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাঁকে দুর্গা বলা হয়। ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই দুর্গা। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে এ দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। তাই দেবীর এক নাম হয় মহিষমর্দিনী। কালীবিলাসতন্ত্র, কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দুর্গোৎসববিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
দুর্গাপূজার প্রচলন সম্পর্কে পুরাণে লিখিত হয়েছে যে, পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন। পূজায় তুষ্টা দেবীর বরে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এ পূজা বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর এক নাম ‘বাসন্তী’ পূজা।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে জানা যায় যে, রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা। বাসন্তী পূজা হয় চৈত্রের শুক্লপক্ষে, আর শারদীয়া পূজা হয় সাধারণত আশ্বিনের কখনও বা কার্তিকের শুক্লপক্ষে। বর্তমানে শারদীয়া পূজাই সমধিক প্রচলিত। এসময় শুক্লা ষষ্ঠীতিথিতে দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নমবী (মহানবমী)-তে পূজা দিয়ে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এদিন দশোহরার মেলা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নতুন পোশাক পরে দশোহরার মেলায় যায়। মেলার দিন নৌকা বাইচ বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। সকলে কোলাকুলি, প্রণাম, আশীর্বাদ ইত্যাদির মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় করে।
দুর্গাপূজা তিন প্রকার: সাত্ত্বিক (জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ ভোগ দ্বারা পূজা), তামসিক (কিরাতদের জন্য বিহিত; এতে জপ, যজ্ঞ ও মন্ত্র নেই; মদ্য, মাংস প্রভৃতি দ্বারা পূজা করা হয়) ও রাজসিক (পশুবলি ও আমিষ ভোগ দ্বারা পূজা করা হয়)। অতীতে দুর্গাপূজার সময় ছাগ, মেষ, মহিষ, হরিণ, শূকর, গন্ডার, ব্যাঘ্র, গোসাপ, কচ্ছপ বা পাখি বলি দেওয়া হতো; কোনো কোনো গ্রন্থে নরবলির বিধানও আছে। বর্তমানে অবশ্য বলির প্রচলন নেই বললেই চলে।
দেবী সাধারণত দশভুজা, তবে শাস্ত্রানুসারে তাঁর বাহুর সংখ্যা হতে পারে চার, আট, দশ, ষোলো, আঠারো বা কুড়ি।
প্রতিমার রং হতে পারে অতসীপুষ্পবর্ণ বা তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, কখনও বা রক্তবর্ণ। প্রতিমা ছাড়াও পূজা হতে পারে দর্পণে, অনাবৃত ভূমিতে, পুস্তকে, চিত্রে, ত্রিশূলে, শরে, খড়গে বা জলে। দুর্গাপূজায় হিন্দুদের সকল বর্ণের লোকেরাই অংশগ্রহণ করতে পারে।
বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩)। কিন্তু জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসববিবেক, কৃত্তিবাস ওঝার (আনু. ১৩৮১-১৪৬১) রামায়ণ, বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি, রঘুনন্দনের (১৫শ-১৬শ শতক) তিথিতত্ত্ব ইত্যাদি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় অনুমান করা হয় যে, বাংলায় দুর্গাপূজা দশম অথবা একাদশ শতকেই প্রচলিত ছিল। হয়তো কংসনারায়ণ কিংবা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে তা জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। উনিশ শতকে কলকাতায় মহাসমারোহে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। অষ্টাদশ শতকের শেষ অব্দি ইউরোপীয়ানরাও দুর্গোৎসবে অংশগ্রহণ করত। ধনীদের গৃহে বাইজি, নর্তকী এবং গায়িকারা অংশগ্রহণ করত। কোথাও কোথাও যাত্রাগান, পাঁচালি ও কবিগানের আসর বসত।
পূজার আগে খড়-মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি করে তাতে কাঞ্চনবর্ণের রং লাগানো হয়। অতীতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িসহ আরও কয়েকটি সম্পন্ন পরিবার প্রতিমায় দামি শাড়ি, এমনকি সোনার গহনা পর্যন্ত পরাত এবং তৎসহ প্রতিমা বিসর্জন দিত। বাংলাদেশের সর্বত্রই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কেউ ব্যক্তিগতভাবে করে, কেউবা সমষ্টিগতভাবে। সমষ্টিগত পূজাকে বলা হয় বারোয়ারি বা সর্বজনীন দুর্গোৎসব।
দুর্গোৎসব উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন সকলে একত্র মিলিত হয়। ঢাকার সর্বজনীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। এছাড়া শতাধিক মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা উপলক্ষে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশন-মন্দিরে অষ্টমীর দিন আট/নয় বছরের একটি বালিকাকে দুর্গা সাজিয়ে কুমারী পূজা করা হয়। দশমীর দিন সরকারি ছুটি থাকে। এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে এবং বেতার-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। দশমীর দিন সকাল থেকে চলে বিসর্জনের আয়োজন। মিছিল সহকারে প্রতিমা নিয়ে বিকেল থেকে শুরু হয় নিকটস্থ নদী-খাল-বিল কিংবা পুকুরে বিসর্জনের পালা। ঢাকার অধিকাংশ প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গার জলে। এভাবে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় পাঁচদিন ব্যাপী দুর্গোৎসব। [দুলাল ভৌমিক]