দাস, হেনা
দাস, হেনা (১৯২৪-২০০৯) শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, নারী নেত্রী। ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরে তাঁর জন্ম। পিতা রায় বাহাদুর সতীশচন্দ্র দত্ত ছিলেন আইনজীবী এবং মাতা মনোরমা দত্ত। হেনা দাস ১৯৪০ সালে সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে পাইলট স্কুল) থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪২ সালে সিলেট মহিলা কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ পাস করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহ মহিলা ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
ছাত্র জীবনেই হেনা দাস স্বদেশী আন্দোলন এবং পরে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে তিনি কংগ্রেস মহিলা লীগের সদস্য এবং পরের বছর গার্ল গাইডের সদস্য হন। ১৯৩৮ সালে তিনি নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন। ১৯৪০ সালে তিনি সুরমাভ্যালি গার্লস’ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। হেনা দাস সহপাঠিদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় জনরক্ষা কমিটি গড়ে তোলেন এবং আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে অংশগ্রহণ করেন।
হেনা দাস ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে মৌলভীবাজার জেলার ভানুবিলে মহিলা আত্মরক্ষা কমিটি গঠন করেন। এ সমিতির সাহায্যে তিনি নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তিনি সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রগতিশীল ‘গণনাট্য সংঘে’র সঙ্গে যুক্ত হন। চল্লিশের দশকে হেনা দাস আসামের কমিউনিস্ট প্রতিনিধি হিসেবে বোম্বে যান। সেখানে সর্বভারতীয় ছাত্র- কমিউনিস্টদের বিশ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যোগ দেন। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে হেনা দাস দশ বছর আত্মগোপনে থাকেন। ১৯৪৮-৪৯ সালে হেনা দাস সিলেটের নানকার কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন এবং চা বাগানের নারী শ্রমিকদের সমন্বয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলেন।
হেনা দাস ১৯৫৮ সালে ঢাকা আসেন এবং সহকারি শিক্ষক হিসেবে গেন্ডারিয়ায় মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষক পদে নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় তিনি শিক্ষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৫-১৯৬৮ সালে তিনি মহাখালী ওয়ারলেস স্টেশন স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পুনরায় নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে তিনি ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যোগ দেন। তিনি ২০০০ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হেনা দাস শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কলকাতায় গিয়ে সকল স্তরের শিক্ষকদের নিয়ে ‘উদ্বাস্ত্ত শিক্ষক সমিতি’ গড়ে তোলেন। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্বাস্ত্ত শিবিরে ৫০ টি ক্যাম্প খুলে ত্রাণ বিতরণ, আশ্রয়, চিকিৎসাসেবা এবং শরণার্থী শিশু-কিশোরদের শিক্ষার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে এসে শিক্ষক নেত্রী হিসেবে তাঁর কর্মকান্ড শুরু করেন।
হেনা দাস ১৯৭৭ সালের ৫ মে ঢাকার শিক্ষক সমিতির আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে ৫৪ জন শিক্ষকসহ গেপ্তার হন এবং তিনদিন কারাভোগের পর মুক্তি পান। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৬ সালে শিক্ষকদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন। সরকার এ ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং হেনা দাসকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। হেনা দাস মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
হেনা দাস ছিলেন একজন লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে উজ্জ্বল স্মৃতি, আমার শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন, স্মৃতিময় দিনগুলো, নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা, স্মৃতিময়-৭১, পঞ্চম পুরুষ এবং তাঁর আত্মজীবনী চারপুরুষের কাহিনী। তিনি জাতীয় দৈনিকের কলাম ও প্রবন্ধ লেখক ছিলেন। বহুমাত্রিক অবদানের জন্য তিনি রাষ্ট্র প্রদত্ত রোকেয়া পদক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আহমদ শরীফ ট্রাস্টসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পদক ও সম্মাননা লাভ করেন।
২০০৯ সালের ২০ জুলাই হেনা দাসের মৃত্যু হয়। [নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ]