দরিয়াও দুর্গ
দরিয়াও দুর্গ একটি মাটির দুর্গ। কামরূপের খেন রাজা নীলাম্বর সম্ভাব্য মুসলিম আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁর দক্ষিণ সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এটি নির্মাণ করেন। তেরো শতকের প্রথমদিকে উত্তর বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পর উত্তরে মুসলিম রাজ্যের সীমা ক্রমে তৎকালীন করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। করতোয়া তখন ছিল বেশ বড় নদী। এর পেছনেই উত্তর-পূর্ব বাংলা ও আসামের হিন্দু রাজ্যসমূহ অবস্থিত ছিল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গভীরে মুসলিমদের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার জন্য কামরূপএ অহোম ও খেন রাজারা করতোয়া অববাহিকার অপর পারে প্রাচীরমালা ও মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। এসব পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষের কিছু কিছু এখনও রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি জেলা এবং কুচবিহার রাজ্যের সন্নিকটে দেখা যায়। এগুলির মধ্যে রয়েছে রংপুরের কান্তদুয়ার, দেবীপুর, বাটাসনের নিকটে দরিয়াও দুর্গ, ডোমারের নিকটে ময়নামতীর গড় ও ধর্মপাল গড়, দিনাজপুরের বেলওয়ারের নিকটে বড় পাইকার গড়, পঞ্চগড়ে ভিতরগড় দুর্গ, দিনাজপুরে ঘোড়াঘাট দুর্গ প্রভৃতি।
এগুলি বাহ্যত অশ্রেণীভুক্ত আদি মধ্যযুগীয় মাটির দুর্গ এবং প্রায়ই বিভিন্ন সময়ে তাড়াহুড়া করে তৈরি করা হলেও এর মধ্যে কোনো কোনোটি খুবই কৌতূহল উদ্দীপক এবং কামরূপের তৃতীয় খেন রাজা নীলাম্বর ও সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এর দরবেশ সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজীর মধ্যকার যুদ্ধের ঐতিহ্য মন্ডিত।
স্থানীয় কৃষকদের দখলে অনেক জমি চলে গেলেও কান্তদুয়ার গ্রামের নিকটে করতোয়া নদীর পরিত্যক্ত গতিপথে অবস্থিত সুরক্ষিত দুর্গটির অস্তিত্ব আগাছায় অর্ধেকটা ডুবে থাকা অবস্থায় এখনও বিদ্যমান। মনে হয় এটি আদিতে পুরু ইটের শক্ত অংশ দিয়ে তৈরি বেষ্টনী দেওয়ালের তিনটি স্বতন্ত্র সারি দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। স্থানীয় জনসাধারণ সাতটি পর্যায়ান্বিত গভীর পরিখার দ্বারা আদি সময়ের সাতটি ধারাবাহিক দেওয়ালের অস্তিতের কথা প্রমাণ করে। নিয়মানুগ দুর্গের সমকেন্দ্রিক পরিবেষ্টক প্রাচীর থেকে সমকোণে অবস্থিত অভিক্ষিপ্ত আবরণী দেওয়ালগুলি আধুনিক সুরক্ষিত ভবন (barbican) বা পর্যবেক্ষণ ইমারতের সাথে তুলনীয়। সমগ্র চত্বরটি প্রায় ৬০০ একর জমিতে বিস্তৃত।
দুর্গ প্রাচীরের সারির মধ্যে আয়তাকার উঁচুভূমিতে কয়েকটি পুরানো ভবনের ধ্বংসাবশেষসহ কয়েকটি ঢিবি পরিলক্ষিত হয়। ভবনগুলির একটি লোকায়তভাবে জনসাধারণের কাছে রাজবাড়ি বা রাজার প্রাসাদ বলে পরিচিত। বেষ্টনী প্রাচীরটি অসমান দূরত্বে জায়গায় জায়গায় কয়েকটি ফাটল (breach) দ্বারা বিভক্ত। এগুলি প্রবেশপথ এবং বিভিন্ন পরিখা থেকে পানি প্রবাহের জন্য খোলা পথ (openings) বলে মনে হয়। অভ্যন্তরস্থ পরিখাটিতে এখনও পানি আছে এবং এটি দক্ষিণ দিকে ঢালু হয়ে গিয়েছে যেখানে এটি সরু ও লম্বা দ্বীপখন্ডের চতুর্দিকের বাঁধের নিচে একটি জলাধার সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার দিকে অভ্যন্তরীণ প্রাচীর থেকে কিছু দূরে একটি উঁচু পথ (cause-way) দেখা যায়। এটি সম্ভবত আদিতে অধিবাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। এর কাছেই রয়েছে বিস্তীর্ণ জলারাশির ওপারে একটি ছোট ঢিবি রয়েছে যা কোনো পুরানো দরগাহ বা অজানা কয়েকজন সুফি দরবেশের কবর বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া, আরও দক্ষিণ দিকে পানির স্তর পর্যন্ত নামানো সিড়ির ধাপসহ একটি পুরানো পুকুর দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে সিড়িটি রাজার ঘাট (রাজার অবতরণের স্থান) নামে পরিচিত। এর পশ্চিম দিকে আর একটি জরাজীর্ণ কাঠামো রয়েছে যা রানীর ঘাট (রানীর অবতরণের স্থান) বলে পরিচিত।
সংরক্ষিত নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও ক্রমাগত অযত্ন ও অবহেলায় কার্যত এটি আগাছায় পূর্ণ আকারবিহীন এক বিশৃঙ্খল ঢিবিতে পরিণত হয়েছে। [নাজিমউদ্দীন আহমেদ]