দত্ত, অক্ষয়কুমার
দত্ত, অক্ষয়কুমার (১৮২০-১৮৮৬) শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রধান কর্মীপুরুষ। জন্ম ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই নবদ্বীপের পাঁচ মাইল উত্তরে, চুপী গ্রামে। তাঁর পিতা পীতাম্বর দত্ত ছিলেন কলকাতার কুঁতঘাটের পুলিশ-কার্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ; পরে সাবইন্সপেক্টর হন। মাতা, দয়াময়ী দেবী।
কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ছাত্র থাকাকালে তিনি পঞ্চম শ্রেণি থেকে ডাবল প্রমোশন পেয়ে তৃতীয় (বর্তমান সপ্তম) শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় শ্রেণি পরীক্ষা পাস করার পরই (১৮৩৫) পারিবারিক রীতি অনুসারে তাঁর বিয়ে হয়। কিছুদিন পরে পীতাম্বর দত্তের মৃত্যু হলে অক্ষয়কুমার দত্তের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ছাত্র থাকাকালেই তিনি সেখানকার শিক্ষক হার্ডম্যান জেফ্রয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বহুভাষাবিদ পন্ডিত জেফ্রয়ের কাছে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শিখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শিখেন ফারসি ও আরবি।
১৮৩৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-এর সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি অক্ষয়কুমার দত্তকে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহিত করেন। এ পত্রিকায় নিয়মিত লেখার সূত্রেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্তের পরিচয় হয়। ১৮৩৯ সালে ৬ অক্টোবর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠিত হলে ২৬ ডিসেম্বর তিনি এ সভার সভ্য হন। পরের মাসেই (জানুয়ারি ১৮৪০) তিনি নির্বাচিত হন এ সভার সহকারী সম্পাদক। ১৮৪০ সালের ১৩ জুন কলকাতায় এ সভার উদ্যোগে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। অক্ষয়কুমার দত্ত এ পাঠশালার শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি পড়াতেন ভূগোল ও পদার্থবিদ্যা। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় পাঠ্যগ্রন্থ না থাকায় তিনি এ পাঠশালার শিক্ষার্থীদের জন্য লেখেন ভূগোল (১৮৪১) ও পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬) বিষয়ক বই। ভূগোল বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞানবিষয়ক বই এবং এ বইয়ের মাধ্যমে অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলা যতিচিহ্নের প্রবর্তন করেন। পদার্থবিদ্যা পরে প্রকাশিত হলেও, এটি বাংলা ভাষায় রচিত বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রথম গ্রন্থ।
১৮৪২ সালের জুন মাসে প্রসন্নকুমার ঘোষের সহযোগিতায় অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ্যাদর্শন নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বাঙালি মননে বিজ্ঞান-মনস্কতা ও বিজ্ঞান-চেতনার উদ্রেক করা ছিল এ পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য। পরবর্তীকালে বিদ্যাদর্শন-এর নাম অনুসারে বঙ্গদর্শন, আর্য্যদর্শন, হিন্দুদর্শন প্রভৃতি পত্রিকার নামকরণ করা হয়। বঙ্গদর্শন, বিদ্যাদর্শন-এর আদর্শ গ্রহণ করেছিল।১৮৪৩ সালের ৩০ এপ্রিল তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা কলকাতা থেকে হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। এ উপলক্ষে অক্ষয়কুমার দত্ত সেখানে বক্তৃতা করে এরকম বিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। ওই বছরের জুন মাসে ডেভিড হেয়ারের স্মরণসভায়ও রীতি ভেঙে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। তাঁর এ বক্তৃতা শ্রীযুক্ত ডেভিড হেয়ার সাহেবের নাম স্মরণার্থ তৃতীয় সভার বক্তৃতা নামে প্রকাশিত হয়। বক্তৃতায় তিনি জাতীয় শিক্ষানীতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং সে শিক্ষানীতি মাতৃভাষায় প্রবর্তিত হওয়া দরকার বলে মত প্রকাশ করেন।
প্রাচীন পাঠক্রম বদলিয়ে তিনি যুগোপযোগী নতুন পাঠক্রম চালু করতে চেয়েছেন। তিনি শিশুর জন্ম থেকে বিশ-বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষাকে তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথমপর্ব শুরু হবে একটি বিশেষ শিশুশিক্ষাকেন্দ্রে- যেখানে শিশুরা দু থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করবে। দ্বিতীয়পর্বের শিক্ষা হবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে- যেখানে ছয়-সাত থেকে চৌদ্দ-পনের বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা হবে। তৃতীয়পর্ব পনের-ষোল থেকে বিশ-বাইশ বছর পর্যন্ত। এটাকে তিনি উচ্চশিক্ষা বলেছেন। তিনি মেধাবী ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য এ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এর প্রসারের জন্য তিনি নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক দান করেন।
১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ও অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা । ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত পত্রিকাটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম ও পারত্রিক জ্ঞান আলোচনা করা। কিন্তু সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের চেষ্টায় সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা প্রাধান্য পায়। ১৮৪৮ জানুয়ারি মাস থেকে এ পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্তের দার্শনিক রচনা ‘বাহ্যবস্ত্তর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ প্রকাশ শুরু হয়। ব্রিটিশ Phrenologist জর্জ কুম্ব (George Combe, ১৭৮৮-১৮৫৮)-এর The Constitution of man considered in relation to external object (1828) গ্রন্থের ভাব অবলম্বনে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে অক্ষয়কুমার দত্ত এটা লিখেছেন। রচনাটি পরে ১৮৫১ ও ১৮৫৩ সালে দুই খন্ডে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১৮৫২, ১৮৫৪ ও ১৮৫৯ সালে তিন খন্ডে প্রকাশিত তাঁর চারুপাঠ গ্রন্থটি ছিল সেকালের জনপ্রিয় পাঠ্যপুস্তক। এতে ছিল নানা জ্ঞানের ছোট ছোট প্রবন্ধ-সহজ কথায় ও সরল ভাষায়, যা সচিত্র ও আকর্ষণীয় রীতিতে পরিবেশিত হতো। এ গ্রন্থের পরিবেশিত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধাবলীর মাধ্যমেই তিনি বিজ্ঞানকে উনিশ শতকের বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গীভূত করে তোলেন। চারুপাঠ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে রম্যরচনারও সূচনা ঘটে। বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব স্মরণীয়। পরবর্তীকালে তাঁর রচিত পরিভাষা সত্তর ভাগেরও বেশি গৃহীত ও প্রচলিত হয়।
অক্ষয়কুমার দত্তের বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ ও ধর্মোন্নতি সংসাধন বিষয়ক প্রস্তাব প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে। প্রথম বইটি ছিল রেলওয়ে সম্পর্কে বাঙালি লেখক কর্তৃক রচিত প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। মানবসভ্যতায় নানা ধর্মের ক্রমবিবর্তন কীভাবে ঘটেছে, শেষোক্ত বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এছাড়া ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত ধর্মনীতি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সমাজচিন্তার পরিণত রূপ। ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় গ্রন্থের দুভাগে (প্রথম ভাগ, ১৮৭০ ও দ্বিতীয় ভাগ, ১৮৮২) তিনি ১৮৫টি ধর্মসম্প্রদায়ের ভাষা, ধর্ম, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সমাজ-বিন্যাস, রাষ্ট্রকাঠামো প্রভৃতি বিবরণ সঙ্কলন করেন। প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার (১৯০১) নামে তাঁর আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। প্রাচীন ভারতবর্ষের কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্য বিষয়ের আলোচনা বইটির প্রধান উপজীব্য।
অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন; কিন্তু ধর্ম ব্যাপারে তিনি নিস্পৃহ ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজে বেদকে ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে মনে করা হয়, কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্ত তা মানতেন না। ১৮৫১ সালের ২৩ জানুয়ারি ব্রাহ্মহ্মসমাজে একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, বেদ ঈশ্বরপ্রত্যাদিষ্ট নয়, বিশ্ববেদান্তই প্রকৃত বেদান্ত, অর্থাৎ ‘অখিল সংসারই আমাদের ধর্মশাস্ত্র। বিশুদ্ধ জ্ঞানই আমাদের আচার্য’ (The whole world is our scripture and pure rationalism is our teacher)। এছাড়া সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলা ভাষায় উপাসনা হওয়া উচিত বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন, ১৮৫৩ সালে খিদিরপুরের ব্রাহ্মসমাজ তা গ্রহণও করেছিল। পরে অবশ্য অক্ষয়কুমার দত্ত ঈশ্বর-উপাসনা বা প্রার্থনা বিষয়টিকেই অগ্রাহ্য করেন। তিনি বীজগণিতের সূত্রের মাধ্যমে দেখিয়ে দেন যে, মানুষের বাসনা পূরণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা নিষ্প্রয়োজন।
১৮৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার কাশীপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘সমাজোন্নতিবিধায়িনী সুহূৎসমিতি’র প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিরোধ প্রভৃতি সমাজসংস্কারমূলক কাজে এ সমিতি উদ্যোগী হয়েছিল।
অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতবর্ষে ইংরেজ মিশনারিদের ধর্মীয় তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করেন। তবে ভারতবর্ষের কিছু মানুষ কেন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল, তার মনস্তাত্ত্বিক আলোচনাও তিনি করেন। তিনি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ নৈতিক অবস্থানের কারণে তিনি উইলিয়ম গর্ডন ইয়ং-এর দেওয়া চাকরি, শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইনসপেক্টর-এর পদ গ্রহণ করেননি। তবে ১৮৫৫ সালের ১৭ জুলাই শিক্ষক-প্রশিক্ষণের জন্য কলকাতায় নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরোধে অক্ষয়কুমার দত্ত তার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত উদ্ভিদ প্রেমিক ছিলেন। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু স্থান থেকে দুর্লভ বৃক্ষচারা সংগ্রহ করে তিনি নিজের বাসভবনে সুপরিকল্পিতভাবে একটি বাগান তৈরি করেন। বাগানটির নাম দিয়েছেন ‘শোভনোদ্যান’। বাগানের প্রত্যেকটি তরু, গুল্ম ও লতার শরীরে উদ্ভিজ্জ-বিদ্যাসম্মত ল্যাটিন নাম ও তার স্বরূপ সংক্ষেপে বর্ণনা করেন। তিনি তাঁর বাড়িতে একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও গড়ে তুলেছেন। ১৮৮৬ সালের ২৭ মে তাঁর মৃত্যু হয়। [মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম]
গ্রন্থপঞ্জি মহেন্দ্রনাথ রায়, শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবন-বৃত্তান্ত, কলকাতা, সংস্কৃত যন্ত্র, ভাদ্র ১২৯২; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, কলকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, মাঘ ১৩৮৮; অসিতকুমার ভট্টাচার্য, অক্ষয়কুমার দত্ত ও উনিশ শতকের বাংলায় ধর্ম ও সমাজচিন্তা, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি ২০০৭; মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, অক্ষয়কুমার দত্ত ও উনিশ শতকের বাঙলা, ঢাকা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, আগস্ট ২০০৯।