তিমিজাতীয় প্রাণী
তিমিজাতীয় প্রাণী (Cetacean) Mammalia শ্রেণির Cetacea বর্গভুক্ত একদল জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। বর্গটি Odontoceti ও Mysticeti নামের দুটি উপবর্গে বিভক্ত। প্রথমটিতে আছে ৭২টি জীবিত প্রজাতি ডলফিন, শুশুক ও অধিকাংশ অপেক্ষাকৃত ছোট তিমি এবং দ্বিতীয়টিতে ১০ প্রজাতি ছাঁকাখাদ্যভুক (filter-feeder) বৃহৎ তিমি। সকল স্তন্যপায়ীরই প্রথম উদ্ভব ডাঙায় এবং সবাই বায়ুশ্বসনকারী ও উষ্ণরক্তবিশিষ্ট। এদের অন্যূন তিনটি স্বতন্ত্র দল পানিতে চলে যায় এবং জলজীবনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য অভিযোজিত হয়। Cetacean (তিমি ও ডলফিন) এবং Sirenian-রা (ম্যানাটি ও ডুগং, Sirenia বর্গভুক্ত) একান্তভাবে জলচর। এদের পশ্চাৎপদ দুটির বিলুপ্তি ঘটেছে ও এরা ডাঙায় চলাচলের ক্ষমতা হারিয়েছে। সিল ও সিন্ধুঘোটক প্রজননের জন্য ডাঙায় আসে এবং বিদ্যমান পশ্চাৎপদ দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে চলাচল করে।
বাংলাদেশের ১০ প্রজাতির Cetacean-এর মধ্যে সাতটি অভ্যন্তরীণ জলাশয় এবং তিনটি সমুদ্রের বাসিন্দা। Cetacean ছাড়া বাংলাদেশের উপকূলের পানিতে ডুগং (Sirenia বর্গভুক্ত Dugongnidae গোত্রের উদ্ভিদভোজী স্তন্যপায়ী) আছে বলেও জানা গেছে। অভ্যন্তরীণ সাতটি Cetacean-এর মধ্যে চারটি হুমকিগ্রস্ত যার বিবরণ নিচে বর্ণিত হলো:
ইরাবতী ডলফিন (Orcaella brevirostris) মাথা ডিম্বাকার ও ভোঁতা, চঞ্চুহীন। গোটা শরীর কালচে ধূসর। পৃষ্ঠপাখনা ছোট ও কাস্তের মতো, আগা গোলাকার, পিঠের মধ্যস্থলের সামান্য পিছনে অবস্থিত। দাঁড়পাখনা (flippers) চওড়া ও ত্রিকোণ। ডলফিনটি প্রায় ২ মিটার লম্বা হয়। উপকূলীয় পানিই এদের পছন্দ; নির্দিষ্ট সময় পর পর শ্বাস নেয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বে নাফ নদীর মুখে ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রণালিতে এবং দক্ষিণে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের নদীগুলিতে এদের বাস। জেলেদের অনিচ্ছাকৃত শিকার হলেও এটাই প্রধান বিপদ। ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার (উত্তরাংশ) উপকূল ও নদীমোহনায় দেখা যায়।
তরমুজ-মাথা ডলফিন (Peponocephala electra) দেহ ক্রমশ সরু, মাথা বড়, উপর বা নিচ থেকে দৃশ্যত ত্রিকোণ, চঞ্চু খাটো ও চওড়া। দাঁতের সংখ্যা ২২/২৩। পিঠের রং কালো; তুন্ড, পৃষ্ঠপাখনা, শ্রোণিপাখনার পুরোভাগ ও পুচ্ছপাখনা ঘন কালো; পেট ধূসর, ফোঁটাহীন। দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৭ মিটার। দাঁড়পাখনা লম্বা (৫০ সেমি), পিছনের দিকে চোখা। নির্দিষ্ট সময় পর পর শ্বাস নেয়। সমুদ্রের উপকূল, উপকূলীয় দ্বীপ ও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের নদীতে থাকে।
পাখনাহীন শুশুক (Neophocaena phocaenoides) পৃষ্ঠপাখনাহীন, শরীর ক্রমশ সরু; ক্রমশ সরু হওয়া দাঁড়পাখনা (flipper) অপেক্ষাকৃত লম্বা এবং আগা ভোঁতা; পুচ্ছ পাখনার মাঝখানে খাঁজ ও কিনারা বাঁকা। পিঠ ও শরীরের প্রায় সর্বত্রই ধূসর এবং তাতে নীলচে অাঁচ। সর্বাধিক ১.৯ মিটার লম্বা। ওজন প্রায় ৩৯ কেজি। দাঁতের সংখ্যা অন্যূন ৫২। পুরুষ আকারে স্ত্রী শুশুক অপেক্ষা বড়। প্রধান খাদ্য ছোট চিংড়ি, ছোট স্কুইড জাতীয় প্রাণী ও মাছ। পাল বা ঝাঁকে দলবদ্ধ হয়ে চলে না। কদাচিৎ ৪-৫টিকে একত্রে দেখা যায়। সাধারণত অক্টোবরে এর একটি করে বাচ্চা জন্মে। লাফ দেয় না বা ডিগবাজিও খায় না, মোটামুটি ধীরগতির এসব শুশুক সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পূর্বে নাফ নদীতে বাস করে।
শুশুক (Platanista gangetica) একসময় এ ডলফিন সব বড় বড় নদীতেই ছিল, বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এটি আকারে ছোট ও গড়ন কৌণিক। তুন্ড লম্বা ও সরু (৪৫ সেমি পর্যন্ত)। রং কালচে থেকে ধোঁয়াটে কালো। স্ত্রী থেকে পুরুষ আকারে বড়। শ্রোণি-দাঁড়পাখনা ত্রিকোণ, চওড়া ও চ্যাপ্টা। পুচ্ছ চওড়া। ডলফিন সর্বাধিক ২.৫ মিটার লম্বা হয়। যূথচর না হলেও কখনও কখনও ছোট দলে দেখা যায়। দেহের পাশের উপর ভর করে সাঁতারে অভ্যস্ত এবং শ্বাস নেওয়ার জন্য কয়েক সেকেন্ড পানির উপর ভেসে ওঠে। চিংড়িজাতীয় প্রাণী ও ছোট মাছ ছেঁকে তোলার জন্য এদের চোয়াল উত্তমরূপে অভিযোজিত। ঘোলা পানিতে চোখ (কার্যত অন্ধ) সম্ভবত দিক নির্দেশে ব্যবহূত হয়। প্রায় ৮-৯ মাস গর্ভধারণের পর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ১টি বা কদাচিৎ ২টি বাচ্চা প্রসব করে। সকল বড় বড় নদী ও মোহনায় পাওয়া যায়। যেখানে সেখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর স্রোতপ্রবাহের পরিবর্তন ও নদীবিভাজন এবং মৎস্যজীবীদের অনিচ্ছাকৃত শিকার ইত্যাদি এদের প্রধান হুমকি। [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]
আরও দেখুন জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী; ডলফিন।