তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী
তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী নুসরত জঙ্গ রচিত ঢাকার ইতিহাস। নুসরত জঙ্গ ১৭৮৫ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ঢাকার নায়েব নাজিম ছিলেন। ১৬১০ সালে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন এবং নতুন রাজধানীর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। ১৭০৪ সালে সুবাহদার ও দীউয়ানের প্রশাসনিক কেন্দ্র যথাক্রমে পাটনা ও মাকসুদাবাদে (পরে মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত হয়। অবশ্য প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের সুশাসনের জন্য মুর্শিদকুলী খান (সুবাহদার, ১৭১৬-১৭২৭) ঢাকাতে ‘নিয়াবত’ (উপ-সুবাহদারী) প্রতিষ্ঠা করে এর শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একজন নায়েব-নাজিম নিযুক্ত করেন। এ নায়েব নাজিমের পদ ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পরও অব্যাহত ছিল।
নুসরত জঙ্গের মাতামহ জসরত খান নওয়াব আলীবর্দী খান কর্তৃক ১৭৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। নওয়াব মীরকাসিম তাঁকে মুঙ্গেরে ডেকে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। মীরকাসিমের পরাজয়ের পর জসরত খান কলকাতায় আসেন। এখানে ইংরেজ কাউন্সিল তাঁকে ঢাকায় নায়েব-নাজিমের পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ জানায়। নিয়োগপত্রের সঙ্গে তাঁকে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৭৭৯ সালে তদীয় দৌহিত্র সৈয়দ মুহম্মদ তাঁর উত্তরাধিকারী হন এবং হাশমত জঙ্গ উপাধি লাভ করেন। ১৭৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই এবং তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গীর প্রণেতা নুসরত জঙ্গ নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। তাঁকে ইনতিজামুদ্দৌলা নাসির-উল-মুলক সৈয়দ আলী খান বাহাদুর ’নুসরত জঙ্গ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী-র কোথায়ও এর রচনার তারিখ উল্লেখ করা হয় নি। কলকাতার বোর্ড অব ট্রেড ঢাকার ইংরেজ আবাসিক তিনিধিকে ঢাকা থেকে ইতিহাসের উৎসসমূহ জোগাড় করে কলকাতা পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ জানায়। আবাসিক প্রতিনিধি যতদূর সম্ভব তথ্যাদি যোগাড় করে এক দীর্ঘ পত্রে ঐ গুলির উল্লেখপূর্বক কলকাতা পাঠিয়ে দেন এবং এ তালিকার মধ্যে নওয়াব নুসরত জঙ্গ কর্তৃক সংগৃহীত বেশ কিছু তথ্য ছিল। অন্য দিকে নওয়াব নুসরত জঙ্গ তাঁর গ্রন্থে নাম উল্লেখ না করে বলেন যে, তাঁর জনৈক ইংরেজ বন্ধুর অনুরোধে তিনি ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। তাই আধুনিক পন্ডিতবর্গ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, ১৭৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে টেইলরের প্রাপ্ত বোর্ডের চিঠি এবং ১৮০০ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর পাঠানো চিঠি- এ দুই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী রচিত হয়। খুব সম্ভব ১৭৯৯ সালের শেষ দিকে তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী রচনা সম্পন্ন হয় এবং যে ইংরেজ ভদ্রলোক নওয়াব নুসরত জঙ্গকে এটি লিখতে অনুরোধ করেন তিনি ঢাকার ইংরেজ আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর ছাড়া অন্য কেউ নন।
তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী আকবরের রাজত্বকালে মুগলদের দ্বারা ঢাকা অধিকৃত হওয়ার পর থেকে গ্রন্থটি রচনার তারিখ পর্যন্ত সময়ের ঢাকার ইতিহাস। ভারত উপমহাদেশে মুসলিম ইতিহাস-সাহিত্যের মানগত ঐতিহ্যের তুলনায় এটি এক দুর্বল নমুনা। গ্রন্থকার দাবি করেন যে, উৎস হিসেবে তিনি পূর্ববর্তীদের লেখা ইতিহাস সাহিত্য ব্যবহার করেছেন। তবে প্রকৃতপক্ষে অনুরূপ দুটি মাত্র গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সেগুলি হলো মুতামাদ খানের ইকবালনামা-ই-জাহাঙ্গীরী ও মুহম্মদ কাজিমের আলমগীরনামা। তাঁর বর্ণিত বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা সংক্ষিপ্ত, কালানুক্রম অসংগতিপূর্ণ এবং প্রায় সকল তারিখ নির্দেশনাই ভুল। তিনি মুর্শিদকুলী খানের সময়কাল থেকে বাংলার ইতিহাসের ধারাবাহিক বর্ণনা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন তবে তা খুবই অপ্রতুল ও ত্রুটিপূর্ণ। আলীবর্দী খান সম্পর্কে তাঁর বিবরণ ছোট হলেও মোটামুটি সঠিক। সম্ভবত আলীবর্দী খান সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে তিনি ইউসুফ আলী খানের আহওয়াল-ই-মহববত জঙ্গ (অথবা তারিখ-ই-বাংলা-মহববত জঙ্গী) ব্যবহার করেন, অবশ্য এর কোনো উল্লেখ নেই। নি মাত্র এক বাক্যে সিরাজউদ্দৌলার পতনের কথা উল্লেখ করেছেন এবং মীরজাফর, মীরকাসিম, জসরত খান, হাশমত খান ও স্বীয় সময়ের অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন।
ঢাকার সরকারি স্থাপনা ও দালান-কোঠার বিবরণ সম্বলিত অধ্যায়টি তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী-র অন্যতম অংশ। এখানে বর্ণিত প্রধানদালানগুলি হলো হোসেনী দালান, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, ঈদগাহ এবং নারায়ণগঞ্জের অদূরে হাজীগঞ্জে (পুরানো খিজিরপুর) মীরজুমলার বন্দর (বা দুর্গ)।
হোসেনী দালান নির্মাণের কাল সম্পর্কে তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী নতুন আলোকপাত করে। লেখক উল্লেখ করেন যে যুবরাজ মুহম্মদ আজমের সুবাহদারির সময় ১৬৭৮-৭৯ সালে হোসেনী দালান নির্মিত হয়। আধুনিক পন্ডিতগণ এ মত গ্রহণ করেন নি। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন যে, যুবরাজ আজমের সুবাহদারির সময় জনৈক মীর মুরাদ এটি তৈরি করেন। যুবরাজ আজম ছিলেন সুন্নি, আর হোসেনী দালান হলো শিয়া স্থাপনা। তাই তিনি এর নির্মাতা হতে পারেন না। আর একটি তথ্য তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গীতে পাওয়া যায় যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এখানে গ্রন্থকার জানান যে মীরজুমলা তদীয় অনুসারী ও বন্ধুদের তাঁর শবদেহ দাফনের জন্য নজফে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। শিহাবুদ্দীন তালিশের তহীয়া-ই-ইবরীয়া গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে মীরজুমলাকে খিজিরপুর বা তার আশে পাশে এবং খুব সম্ভবত খিজিরপুর দুর্গের অভ্যন্তরেই (বর্তমানে হাজীগঞ্জ দুর্গ নামে পরিচিত) সমাহিত করা হয়েছিল। শিহাবুদ্দীন তালিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাই এখানে তাঁর বক্তব্য নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সম্ভবত মীরজুমলা তাঁর কফিন নজফে পাঠানোর অভিপ্রায় প্রকাশ করেন, কেননা শিয়াদের পক্ষে তাঁদের পবিত্র স্থান নজফে সমাহিত হওয়ার অভিলাষ থাকা খুবই স্বাভাবিক।
অন্য আর এক দৃষ্টিকোণ থেকেও তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গী গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা অঞ্চলে লিখিত এটিই সর্বপ্রথম স্থানীয় ইতিহাস। পন্ডিতগণ এ যাবত মনে করে আসছিলেন যে, ফ্রান্সিস হ্যামিল্টনই প্রথম স্থানীয় ইতিহাস রচনা করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮০৭ সালে স্থানীয় ইতিহাস রচনার জন্য তাঁকে নিয়োজিত করে। বাংলার বহু জেলায় দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের পর তিনি এক বিবরণ লিপিবদ্ধ করে ১৮১৬ সালে সরকার বাহাদুরের নিকট জমা দেন। সরকার ১৮৩৩ সালে A Geographical, Statistical and Historical Description of the District or Zilla of Dinajpur in the Province or Subah of Bengal নামে তা প্রকাশ করে। কিন্তু এখন মনে হয় খুব সম্ভব ১৭৯৯ সালে রচিত তারি-ই-নুসরত জঙ্গীই বাংলা মুলুকে লিখিত প্রথম স্থানীয় ইতিহাস। [আবদুল করিম]
গ্রন্থপঞ্জি Harinath De (ed)., Tarikh-i-Nusrat Jangi in the Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Calcutta, VI, No II, 1911; A Karim, ‘An Account of the district of Dacca dated 1800’ in the Journal of the Asiatic Society of Pakistan, VII, 1962; Muhibullah Siddiqui, ‘Naba Mullayane Tarikh-i-Nusrat Jangi’ in Abdul Karim Sambardhana Grantha, Chittagong, 2001.