তফসিলি সম্প্রদায়
তফসিলি সম্প্রদায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নিয়ে গঠিত এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনুন্নত বলে বিবেচিত একটি রাজনৈতিক শ্রেণি। মর্লি-মিন্টো সংস্কার-এর (১৯০৯) সময় থেকে বাংলার মুসলমানরা যখন তাদের রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার কারণে স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার লাভ করে, তখন থেকে হিন্দু অনুন্নত শ্রেণির সংগঠনগুলিও তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার কারণে অনুরূপ সুবিধালাভের দাবি জানিয়ে আসছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দু প্রভাবিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাছে তাদের এ দাবি কখনো আন্তরিক সমর্থন পায় নি। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও পরিচয় নির্ণয়ের বাস্তব অসুবিধার কথা বিবেচনা করে কংগ্রেস অনুন্নত শ্রেণিগুলিকে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা দানের বিরোধিতা করে আসছিল। কিন্তু বাংলার অনুন্নত শ্রেণিসমূহ বিশ শতকের শুরু থেকে বিভিন্ন বর্ণভিত্তিক সংগঠন ও সমিতির অধীনে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে থাকে এবং তাদের দাবিগুলি সরকারের সহানুভূতিশীল সমর্থন লাভ করে। সাইমন কমিশন রিপোর্ট ও গোলটেবিল বৈঠক অনুন্নত শ্রেণির লোকদের রাজনৈতিক স্বীকৃতি দানের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করে। অবশেষে কংগ্রেসও পুনা প্যাক্টে (১৯৩২) তাদের দাবি মেনে নেয়। অনুন্নত শ্রে~ূণ বা অস্পৃশ্য কথার মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক কালিমা জড়িয়ে আছে তা অপনোদনের জন্য বঙ্গীয় সরকার ১৯৩২ সালে ৭৬টি হিন্দু নিম্নবর্ণের লোকদের তফসিলি সম্প্রদায় অভিধায় আখ্যায়িত করে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রথম তফসিলে এদের উল্লেখ রয়েছে।
এ আইনে বলা হয়েছে যে, যেসব বর্ণ সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতি ইতঃপূর্বে ‘অনুন্নত শ্রেণি’ হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন থেকে তারা ‘তফসিলি সম্প্রদায়’ রূপে আখ্যায়িত হবে। এ আইনে বঙ্গীয় আইনসভার ২০% আসন তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত হয়। মুসলমানদের ন্যায় তারা সংরক্ষিত আসনের বাইরেও সাধারণ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার লাভ করে। এভাবে ১৯৩৭, ১৯৪৬ ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তফসিলি সম্প্রদায় বাংলার রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যে সকল মন্ত্রিসভা গঠন করে তা আইন পরিষদে তফসিলী সম্প্রদায়ের সদস্যদের সমর্থনেই গঠিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধানে (১৯৫৬) নীতিগতভাবে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি রহিত করা হয়। এরপর থেকে পাকিস্তানে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সকল নির্বাচন সম্মিলিত নির্বাচকমন্ডলী পদ্ধতির অধীন প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। [সিরাজুল ইসলাম]