তন্ত্র

তন্ত্র শাস্ত্রবিশেষ। ‘তন্ত্র’ শব্দের অনেক অর্থের মধ্যে একটি হলো ত্রাণ বা মুক্তি। যে শাস্ত্রানুযায়ী সাধন করলে জীবের মোক্ষ বা মুক্তি লাভ হয়, সাধারণভাবে তাকেই বলা হয় তন্ত্র। তত্ত্ব ও মন্ত্রের সমন্বয় হচ্ছে তন্ত্র; এর সাধনার দ্বারা জীব উন্নততর স্তরে পৌঁছতে পারে বলে তান্ত্রিকদের বিশ্বাস। তন্ত্র শ্রৌতজ্ঞানভিত্তিক বলে একে ‘পঞ্চম বেদ’ নামেও অভিহিত করা হয়।

তন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কলিযুগে বেদমন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পেলে জীবের মোক্ষ লাভের উপায় হিসেবে তন্ত্রের উদ্ভব হয়। প্রকৃত ঘটনা হয়তো এই যে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজন ও রুচির যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনি অন্যান্য বিষয়ের মতো শাস্ত্রাদিরও পরিবর্তন ঘটেছে। তাছাড়া শাস্ত্রমতে কলিযুগে মানুষের আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ায় বিশাল বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী সাধনা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে; তাই বিকল্প হিসেবে তন্ত্রশাস্ত্রের উদ্ভব ঘটে। কলিযুগে তন্ত্রোক্ত মন্ত্র আশুফলপ্রদ; জপ, তপ, যজ্ঞ প্রভৃতি সব কর্মেই তা প্রশস্ত। তাই বঙ্গের বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য (১৫শ-১৬শ শতক) তন্ত্রশাস্ত্রকে প্রামাণিক বলে গ্রহণ করেছেন।

বিষয়গত দিক থেকে তন্ত্রশাস্ত্র প্রধানত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত আগম, যামল ও তন্ত্র। সৃষ্টি, প্রলয়, দেবপূজা ইত্যাদি সপ্ত লক্ষণযুক্ত রচনাকে বলা হয় আগম; সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতিষ, বর্ণভেদ, নিত্যকর্ম, যুগধর্ম ইত্যাদি আটটি লক্ষণযুক্ত রচনা যামল এবং সৃষ্টি, লয়, দেবতাদের কাহিনী, তীর্থবর্ণন, আশ্রমধর্ম, পুরাণাখ্যান, নারী-পুরুষের লক্ষণ, রাজধর্ম, যুগধর্ম ইত্যাদি লক্ষণযুক্ত রচনাকে বলে তন্ত্র। তবে এই পার্থক্য সর্বৈব রক্ষিত হয়নি।

সম্প্রদায়গত দিক থেকে তন্ত্র প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্র। ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুতন্ত্রকে বলা হয় শিবোক্ত শাস্ত্র। এর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদীয় নৃসিংহতাপনীয় উপনিষদে। শঙ্করাচার্য এর ভাষ্য রচনা করেছেন বলে অনুমান করা হয় যে, সপ্তম শতকের পূর্বেই হিন্দুতন্ত্র রচিত হয়েছে এবং তার অনুকরণে রচিত হয়েছে বৌদ্ধতন্ত্র। খ্রিস্টীয় ৯ম থেকে ১১শ শতকের মধ্যে বহুসংখ্যক বৌদ্ধতন্ত্র তিববতি ভাষায় অনূদিত হয়; সুতরাং মূল তন্ত্রসমূহ ন্যূনপক্ষে এর এক-দেড়শ বছর আগে রচিত হয়েছে সন্দেহ নেই। মধ্যযুগ হচ্ছে তন্ত্রসাহিত্যের গৌরবময় যুগ। আধুনিক যুগে তন্ত্রশাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা বড় পন্ডিত ছিলেন ভাস্কর রায় (১৮শ শতক)। তাঁর রচিত বামকেশ্বরতন্ত্রের অনেক টীকা রচিত হয়েছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্ব কায়েম হওয়ার পরেও অনেক তন্ত্র রচিত হয়েছে; এর প্রমাণ কোনো কোনো তন্ত্রে ‘লন্ড্রজ’, ‘ইঙ্গ্রেজ’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার।

তন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে বঙ্গদেশে। বঙ্গে বৌদ্ধধর্ম হীনবীর্য হয়ে পড়লে তান্ত্রিক ধর্ম প্রচারিত হয় এবং এখান থেকেই এক সময় তা সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮০-১০৫৩) তিববতে গিয়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬), বামাক্ষ্যাপা (১৮৩৭-১৯১১) প্রমুখ সিদ্ধপুরুষ তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। অর্ধকালী নামে জনৈকা বাঙালি মহিলাও তন্ত্রসাধক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তান্ত্রিকদের ইষ্ট দেবী হলেন কালী, তারা বা ভৈরবী। বঙ্গের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ এখন তন্ত্র অনুযায়ীই সম্পন্ন হয়। তারা বঙ্গে তান্ত্রিকমতে দীক্ষাগ্রহণ হিন্দুদের জীবনে অপরিহার্য; বৈদিক দীক্ষার প্রচলন এখন আর নেই। তান্ত্রিক দীক্ষার আবশ্যকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, অদীক্ষিত ব্যক্তির জপ-পূজাদি নিষ্ফল হয় এবং মৃত্যুর পরে তার নরকে গতি হয়। তান্ত্রিক মতের পূজা এখনও কোনো কোনো মন্দির এবং রক্ষণশীল পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, তন্ত্রে তাদের ব্যবহারিক জীবনে সুখ-সম্পদ লাভের জন্য করণীয় বিভিন্ন প্রকার আচার-আচরণের বিবরণ আছে। এছাড়া বশীকরণ, বিদ্বেষণ, উচ্চাটন, অভিচার ইত্যাদি গুহ্য কর্মকান্ড তন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

হিন্দুতন্ত্র প্রধানত শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ভেদে ত্রিবিধ। তান্ত্রিকগণ স্বস্ব সম্প্রদায়ের তন্ত্র অনুযায়ী তাঁদের ক্রিয়াকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তন্ত্রশাস্ত্রে সাত প্রকার আচারের কথা বলা হলেও মূলত দক্ষিণাচার ও বামাচার এই দুই প্রকার আচারই প্রধান। দক্ষিণাচারীরা বেদোক্ত বিধি অনুযায়ী চলে; তারা মাছ, মাংস, মদ্য ইত্যাদি পরিহার করে। অপরপক্ষে বামাচারীরা অনেক বেদবিরোধী আচরণ করে এবং মৎস্যাদি তাদের নিকট নিষিদ্ধ নয়, এমনকি নারীসঙ্গও। অতীতে বঙ্গদেশে তান্ত্রিক বলতে বামাচারীদেরই বোঝাত; বর্তমানে উভয় প্রকারই রয়েছে।

তন্ত্রের সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে কয়েকটি প্রধান হিন্দুতন্ত্র হলো: সারদাতিলক, যোগিনীতন্ত্র, বারাহীতন্ত্র, বিশ্বসারতন্ত্র, দুর্গাডামর, রুদ্রযামল, তন্ত্রসার, সরস্বতীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র ইত্যাদি। কয়েকটি বৌদ্ধতন্ত্র হলো: হেবজ্র, বারাহীকল্প, মরীচিতন্ত্র, উড্ডামরতন্ত্র, ক্রিয়াসার, মঞ্জুশ্রীতন্ত্র, প্রমোদমহাযুগ, কৌলজ্ঞাননির্ণয় ইত্যাদি। হিন্দুতন্ত্রসমূহ যেমন শিবোক্ত বলে কথিত, তেমনি বৌদ্ধতন্ত্রগুলি বজ্রসত্ব বুদ্ধ কর্তৃক বর্ণিত বলে উক্ত হয়। উল্লেখ্য যে, তন্ত্রসকল সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং বর্তমানে সেসবের যে পুথিসমূহ দেশের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে সেগুলি বঙ্গাক্ষরে লিখিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন সংগ্রহশালায় প্রচুর তন্ত্রের পুথি রয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো এক সময় এ অঞ্চলেও তন্ত্রের ব্যাপক চর্চা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত সবচেয়ে প্রাচীন তন্ত্রের পুথি হলো ১৪৩৯ খ্রিস্টাব্দে গাছের বাকলে লিখিত সারদাতিলক (নং-৪৬০৮)।

তন্ত্রশাস্ত্রের কয়েকজন প্রধান রচয়িতা হলেন: শীলভদ্র (৭ম শতক), শান্তিদেব (জহোর/সাভার, ৭ম শতক), কুমারবজ্র (১০ম শতক), মৎস্যেন্দ্রনাথ (চন্দ্রদ্বীপ/সন্দ্বীপ, ১০ম শতক), অভয়াঙ্কর গুপ্ত (১১শ শতক), মহামহোপাধ্যায় পরিব্রাজকাচার্য (১৪শ শতক), সর্বানন্দ (মেহার, ১৫শ শতক), কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (নবদ্বীপ, ১৬শ শতকের প্রথমভাগ), ব্রহ্মানন্দ গিরি (১৬শ শতক), পূর্ণানন্দ পরমহংস পরিব্রাজক (নেত্রকোনা, ১৬শ শতক), গৌড়ীয় শঙ্কর (১৬শ-১৭শ শতক), হরগোবিন্দ রায় (শ্রীহট্ট, ১৯শ শতক) প্রমুখ।  [দুলাল ভৌমিক]