ঢাকা মাতৃনিকেতন

ঢাকা মাতৃনিকেতন  পতিতা নারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র। ১৮৯৬ সালে শশিভূষণ মল্লিক (১৮৫৭-?) নিজের বাড়িতে ‘ঢাকা বালিকা উদ্ধার আশ্রম’ নামে এর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৮ সালে এর কার্যালয় স্থানান্তরিত হয় নিমতলার বিধানপল্লীর একটি ভাড়া বাড়িতে এবং ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম গভর্নমেন্ট মাতৃনিকেতন অধিগ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত (১৮৯৮-১৯০৮) এখানেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

শশিভূষণ ১৮৮৫ সালে পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং তারপরই এ সমাজসেবা শুরু করেন। এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন তাঁর স্ত্রী নগেন্দ্র বালা। তাঁর ভূমিকা ছিল প্রধানত পতিতা নারীমুক্তি আন্দোলনে। মাতৃনিকেতন উদ্ধারকৃত মেয়েদের শুধুমাত্র শিক্ষা ও ভরণ-পোষণই নয়, তাদের উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া, আত্মীয়দের নিকট প্রত্যর্পণ করা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলার দায়িত্বও পালন করত। শুধু উদ্ধারকৃত মেয়েরাই নয়, এখানে স্থান পেয়েছে বাল্যবিধবা, বয়স্কা বিধবা এবং পিতৃমাতৃহীন মেয়েরাও। এ কারণে পরবর্তীকালে এর নামকরণ করা হয় মাতৃনিকেতন।

মাতৃনিকেতনের উদ্ধার কাজ শুরু হয় মূলত একটি সামাজিক অপরাধমূলক ঘটনা থেকে। নারায়ণগঞ্জ থানার পুলিশ ‘সুন্দরী’ নামের একটি নিরপরাধ মেয়েকে কামনার শিকার হতে উদ্ধার করে সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য সংস্কারকদের হাতে তুলে দেয়ার পরই পতিতা নারীদের এ মুক্তি কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৯৫ থেকেই প্রগতিশীল সংস্কারকগণ এরূপ কদর্য সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে নানা পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তাঁরা নাবালিকা হরণের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, এর প্রতিরোধের জন্য মামলা দায়ের, এমনকি এ বিষয়টি তদানীন্তন বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে উত্থাপনের মতো কার্যক্রমও গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন পতিতাদের প্রতি সুশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং তাদের সামাজিক পুনর্বাসন।

মাতৃনিকেতনে পতিতারা সন্তানস্নেহে পালিত হতো। তাদের মধ্যে নারীপাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত স্নেহবালা (১৮৮৬-?) পরবর্তীকালে মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাস করে লেডি ডাক্তার হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। উনিশ শতকের বিশের দশক থেকে বিশ শতকের বিশের দশকের পূর্ব পর্যন্ত রেনেসাঁর প্রধান কথা ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতিষ্ঠা এবং জাতির জাগরণ। সমাজসংস্কার আন্দোলন, সতীদাহ নিরোধ, বাল্যবিবাহ নিরোধ, বিধবা বিবাহ ও নারীশিক্ষা প্রচলন প্রভৃতি আন্দোলনের মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে নারীমুক্তি। কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক রেনেসাঁয় রূপজীবীদের উদ্ধার প্রচেষ্টা তেমন সফলতা লাভ করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে এ মাতৃনিকেতনের মাধ্যমে ঢাকাতেই নারীমুক্তি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। বাংলার রেনেসাঁ ঢাকায় উজ্জ্বল মূর্তিমতী হয়ে ওঠে এসব উদ্ধারকৃত মেয়েদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে।  [মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি]