ঢাকা, ভূতত্ত্ব
ঢাকা, ভূতত্ত্ব (Dhaka City, Geology) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা প্রায় ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। এ যাবৎ প্রাপ্ত সর্ব প্রাচীন মানচিত্রে ধোলাই খাল ও বুড়িগঙ্গা নদীর সংযোগস্থলে ১.৫ বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে ঢাকা শহরের অবস্থান দেখানো হয়েছিল। ১৯০৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশরাজ কর্তৃক ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঘোষণার পর থেকে ব্যাপক নগরায়ণ শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ার পর ঢাকা মহানগরীর মর্যাদা পায় এবং তখনই নগরীর ব্যাপ্তি প্রায় ৪০ বর্গ কিমি হয়। তবে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার পর ঢাকা শহরের গুরুত্ব অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নগরীর আয়তন ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয় এবং ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর বা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আয়তন হয় ১৬০০ বর্গ কিমি ও জনসংখ্যা প্রায় ৬৮ লক্ষাধিক। একই শুমারিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এলাকা ধরা হয় ৩৬০ বর্গ কিমি এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষাধিক। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৯০ লক্ষ।
ঢাকা ২৩°৪২´ ও ২৩°৫৪´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°২০´ ও ৯০°২৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এ নগরীর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে তুরাগ, পূর্বে বালু ও উত্তরে টঙ্গীখাল অবস্থিত। এখানে সুস্পষ্ট ঋতু তিনটি শীতকাল (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) ১০° থেকে ২০°সে তাপমাত্রার মধ্যে শুষ্ক আবহাওয়া বিশিষ্ট, প্রাক্-বর্ষাকাল (মার্চ-মে) কদাচিৎ বৃষ্টি ও ৪০°সে পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বর্ষাকাল (জুন-অক্টোবর) অত্যন্ত আর্দ্র এবং তাপমাত্রা ৩০° সেলসিয়াসের মধ্যে। ঢাকায় বছরে প্রায় ২০০০ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে যার ৮০ শতাংশই বর্ষাকালে সংঘটিত হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরেই প্রধানত ঢাকার নগরায়ণ সীমিত। ঢাকা নগরীর চারশ বছরের ইতিহাসকে উন্নয়নের ৫টি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়, যেমন: প্রাক্-মুগল আমল (১৬০৮ সালের পূর্বে), মুগল আমল (১৬০৮-১৭৬৪), ব্রিটিশ আমল (১৭৬৪-১৯৪৭), পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১) ও বাংলাদেশ আমল (১৯৭১ থেকে)।
ভূতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় না এনে ঢাকা শহরে দ্রুত নগরায়ণের কারণে নগর এলাকার ভূ-পরিবেশে (geo-environment) গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। জলাবদ্ধতা, দূষণ, জলতাত্ত্বিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন, স্থান বিশেষে ভূমির অবনমন ও ভবন ধ্বসে পড়া এসব সমস্যা ভূ-পরিবেশ সংক্রান্ত পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। বিগত ৩০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ৯০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০ মিটার নিচে নেমে গেছে। শিল্প-কলকারখানা ও পৌর কাজের দূষিত বর্জ্য নগরীর ভিতরে ও এর আশপাশে যত্রতত্র জমা করা এবং নিচুভূমি ও প্রাকৃতিক খাল-নালায় নিষ্কাশিত হওয়ায় ঢাকা শহরের পানি সম্পদ দূষিত হচ্ছে।
ভূতত্ত্ব (geology) ঢাকা মধুপুর গড় নামে পরিচিত প্লাইসটোসিন সোপানের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। দুটি ভূতাত্ত্বিক ইউনিট নগর ও এর আশপাশ এলাকাকে ঘিরে আছে। যেমন- প্লাইসটোসিন যুগের মধুপুর কর্দম ও সাম্প্রতিক কালের পলিজ অবক্ষেপ। মধুপুর কর্দম শহরটির ভিতরে ও বাইরে প্রকটিত সবচেয়ে প্রাচীন অবক্ষেপ। ঢাকার রয়েছে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ভূ-প্রকৃতি ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। নগরীর উল্লেখযোগ্য ভূ-প্রাকৃতিক ইউনিটসমূহ হচ্ছে: উচ্চভূমি বা ঢাকা সোপান, নিম্নভূমি বা প্লাবনভূমি, খাদ এবং পরিত্যক্ত খাল। ঢাকা শহরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো রাজধানীর ভিতর ও নিকটবর্তী এলাকাসমূহে নিম্নজলাভূমি ও খালবিল এবং প্রাকৃতিক হ্রদ যেমন ধানমন্ডি ও গুলশান লেকের অবস্থান।
ঢাকায় ৩০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত অন্তঃভূ-পৃষ্ঠ পাললিক স্তরক্রম থেকে তিনটি সুস্পষ্ট ভূতাত্ত্বিক এককের অস্তিত্ব ধরা পড়ে, যথা- প্লাইসটোসিন যুগের মধুপুর কর্দম স্তরসমষ্টি। পলি ও অতি মিহি বালুকণা সহযোগে লালাভ আঠালো (plastic) কাদা এর বৈশিষ্ট্য। মধুপুর কর্দম স্তরসমষ্টি মাঝারি থেকে মোটা হলুদাভ বাদামি বালু ও মাঝে মাঝে নুড়িতে গঠিত প্লায়ো-প্লাইসটোসিন যুগের ডুপি টিলা স্তরসমষ্টির উপর অসংগতভাবে অধিশায়িত। নগর এলাকার ভিতরে খোদিত খাল ও খাদসমূহের তলদেশ সাম্প্রতিক পলিজ প্লাবনভূমি অবক্ষেপে পূর্ণ যা আবার নিম্নভূমি পলল ও উচ্চভূমি পললে বিভক্ত।
ভূতাত্ত্বিক কাঠামো ও রৈখিক চির (structure and lineament) ঢাকা মহানগর এলাকায় কোনো ভূ-পৃষ্ঠ ভাঁজ পরিলক্ষিত হয় না। তবে বিমান থেকে গৃহীত আলোকচিত্রের ব্যাখ্যায় এবং নদনদীর গতিপ্রকৃতি থেকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তরপূর্ব-দক্ষিণপশ্চিম ও উত্তরপশ্চিম-দক্ষিণপূর্ব দিক প্রবণতাবিশিষ্ট অসংখ্য চ্যুতি ও বৈশিষ্ট্যসূচক রেখা ধরা পড়েছে। নগরীর চারটি দিকই বড় বড় চ্যুতি দ্বারা বেষ্টিত।
ভূকম্পন ও নব-ভূগঠন প্রক্রিয়া (seismicity and neotectonics) ভূমিকম্পের আশঙ্কা ও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য তীব্রতার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিনটি ভূকম্পনীয় অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণীবিন্যাসে ঢাকা শহর ও এর আশপাশকে ভূকম্পনীয় অঞ্চল-২ অর্থাৎ মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়েছে। বেশ কিছু গবেষক ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলের নব-ভূগাঠনিক বিচলনের কথা উল্লেখ করেছেন। মধুপুর উচ্চভূমি গঠনগতভাবে দেশের উচ্চ অঞ্চল যার মধ্যে ঢাকা-টঙ্গী ব্লকটি সবচেয়ে উত্থিত অংশ। এ গড়ের দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তগুলি ধাপচ্যুতি দ্বারা চিহ্নিত।
ভূ-কারিগরি বৈশিষ্ট্যসমূহ (geotechnical characteristics) ঢাকা শহর ও এর আশপাশের মধুপুর কর্দমের ভূ-কারিগরি বৈশিষ্ট্যসমূহে বায়বীয় ও উল্লম্ব উভয়দিক দিয়ে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। মূল্যায়িত মাপকাঠিগুলি বিশেষ করে এর কম শক্তি ও উচ্চ সংকোচনশীলতা গুণ থেকে ধারণা করা হয় যে এ মাটি কিছুটা হলেও প্রকৌশলি নির্মাণের জন্য সমস্যাসংকুল। আর্দ্রতার পরিমাণ ও প্লাস্টিক সীমার ফলাফলে দেখা গেছে মধুপুর কর্দম সাধারণত এঁটেল থেকে অতি এঁটেল প্রকৃতির। এ মাটি স্বাভাবিক থেকে সক্রিয় এবং মধ্যম থেকে উচ্চ প্লাস্টিক মানসম্পন্ন। এ সংকোচনশীলতা গুণ থেকে ধারণা করা যায় যে, এ মাটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে খুব কম থেকে অতিমাত্রায় সংকোচনশীল।
জলতত্ত্ব (hydrogeology) ঢাকা মহানগরীর পানির প্রধান উৎস হচ্ছে ডুপি টিলা স্তরসমষ্টির বালুময় জলস্তর। মধুপুর কর্দম ৮ থেকে ৪৫ মিটার (গড়ে ১০ মিটার) পুরুত্ব নিয়ে এ জলস্তরের উপর অধিশায়িত। এ জলস্তরের পুরুত্ব ১০০ থেকে ২০০ মিটারের (গড়ে ১৪০মি) মধ্যে ওঠানামা করে। নগরীর মধ্যভাগে ২৬ থেকে ৩০ মিটার গভীরতায় ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যায়। শহরের প্রান্তভাগে অন্তঃভূজলপৃষ্ঠ হলো ১৫ থেকে ২০ মিটার গভীরে। বর্তমানে ডুপি টিলার বালু নদী তলদেশ বরাবর প্রকটিত হওয়ার কারণে প্রান্তিক নদীসমূহ পুনঃসঞ্চারকের উৎস হিসেবে কাজ করে। পুনঃসঞ্চারকের অন্যান্য উৎসসমূহ হচ্ছে বৃষ্টি ও বন্যার পানির উল্লম্ব অনুস্রবণ, পানি সরবরাহের পাইপ ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা থেকে নিঃসরণ এবং নগরীর স্থির জলমহাল থেকে নিঃসরণ। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]