ট্রুথ কমিশন
ট্রুথ কমিশন আনুষ্ঠানিক নাম ট্রুথ অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি কমিশন। তবে ট্রুথ কমিশন নামেই সমধিক পরিচিত। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী যে নজির রয়েছে তা থেকে এ কমিশন বলতে আইনত স্বীকৃত এমন এক কমিশনকে বুঝায় যা আইনে অভিযুক্ত হওয়া থেকে অব্যাহতি বা দায়মুক্তি প্রদান করে। এই দায়মুক্তি এমন ব্যক্তিকে দেয়া হয় যিনি স্বাভাবিক আইনে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধে তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বেচ্ছায় প্রকাশ করেন। বিশ্বের কয়েকটি দেশে ট্রুথ কমিশনের ডজন খানেকের বেশি দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ব্যাপার কিছুটা ভিন্ন।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতার পটভূমিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনাবাহিনী সমর্থিত জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সরকার দুর্নীতি দমনের পদক্ষেপকে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করে। বিশেষ করে এই দুর্নীতি দমন অভিযানে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা আটক করা হয়। এরপর যেভাবে ও যে পদ্ধতিতে তাদের বিচারকার্য শুরু হয় অচিরেই তা বিতর্কিত হয়ে দাঁড়ায় এবং বিশেষত সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও মিডিয়ার পক্ষ থেকে সমালোচনার ঝড় উঠে।
ট্রুথ কমিশন গঠনের অধ্যাদেশ ২০০৮ সালের ৮ জুন সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। এ আইনে কমিশনের সংজ্ঞা দেয়া হয় ট্রূথ অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি কমিশন। কমিশন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের সমন্বয়ে গঠিত হয়। কোনো ব্যক্তি তার আয়ের জ্ঞাত সূত্রের বাইরে অর্জিত বা করায়ত্ত সম্পদের সমপরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেয়ার শর্তে স্বেচ্ছায় আইন বা বিচারের হাত থেকে অব্যাহতি চাইলে তাকে সেই অব্যাহতি দানের ক্ষমতা এই কমিশনের হাতে দেয়া হয়। আইন অনুযায়ী কমিশন গঠিত হওয়ার তারিখ থেকে পাঁচ মাস উত্তীর্ণ হবার পর আপনা থেকেই এটি বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা। অবশ্য যেসব মামলার নিষ্পত্তি হয় নি সেগুলোর ক্ষেত্রে কমিশনকে তার কাজ চালিয়ে যেতে দেয়া হয়। কমিশন ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু ছিল।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে নবনির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর জাতীয় সংসদের জনৈক সদস্যের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে ওই বছরের ১ এপ্রিল ৪৪৮ ব্যক্তির একটি তালিকা সংসদে পেশ করা হয়। মিডিয়ার পরিবেশিত খবর (দৈনিক সমকাল, ২ এপ্রিল ২০০৯) অনুযায়ী তালিকায় ৩০০ সরকারি কর্মচারী ও তাদের অনুগ্রহভাজনের নাম ছিল এবং এদের ৭১ জন ছিল মহিলা। সবশুদ্ধ তারা ৩৪ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন।
কমিশন গঠিত হবার কিছুকাল পর কমিশনের আইনগত বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৮ সালের ১৩ নভেম্বর এক রায়ে কমিশনকে অসিদ্ধ ও আইনগত কার্যকারিতা বহির্ভূত ঘোষণা করে। কমিশন আপিল বিভাগের কাছ থেকে স্থগিতাদেশ লাভে সক্ষম হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারির পর গঠিত জাতীয় সংসদ ট্রুথ কমিশন গঠন সংক্রান্ত অধ্যাদেশকে আইনের মর্যাদা না দেয়ায় দায়মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভাগ্যে কি ঘটবে তা নিয়ে আরোও বিতর্ক দেখা দেয়। [এ.এম.এম শওকত আলী]