টোকাই

টোকাই পথে ঘাটে, আবর্জনা ফেলবার স্থানে পড়ে থাকা দ্রব্য সংগ্রহকারী দরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশু-কিশোর। খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট রফিকুন্নবী এ টোকাই চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। টোকাই চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দারিদ্র, বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র তুলে ধরেছেন।

ঢাকা মহানগরীতে লক্ষাধিক বস্তিবাসী মানবেতর পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করে থাকে। দারিদ্র্যপীড়িত এ সকল পরিবার তাদের শিশুদের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করতে কখনোই সক্ষম হয় না। এর পরিণতিতে বস্তির শিশুরা বাধ্য হয়ে অপরিণত বয়সে রোজগারে নামতে বাধ্য হয়। ঢাকা শহরের সাধারণ চিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে এ টোকাইরা। অধিকাংশ টোকাইর বয়স ৮ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, তবে এর অধিক বয়স গ্রুপের টোকাইও দেখতে পাওয়া যায়। সচরাচর ছেলে টোকাইদের তুলনায় মেয়ে টোকাই-এর সংখ্যা অল্প। অধিকাংশ টোকাই নিরক্ষর এবং শহরে নতুন আগমুতক। সাধারণত এরা বড় পরিবারের সদস্য হওয়ায় পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বা খোঁজখবর এদের ওপর থাকে না। অধিকাংশ টোকাইরই বাবা অথবা মা নেই। কেউ কেউ তাদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্তও বটে।

জনসমাগমপূর্ণ স্থানে প্রধানত বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল, বিপণিকেন্দ্র, রাজপথ, আবাসিক এলাকা, ডাস্টবিনের কাছাকাছি টোকাইরা তাদের রোজগারের সন্ধানে বেশি ব্যস্ত থাকে। বেঁচে থাকার জন্য এরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে থাকে। দিনরাত খেটে এরা দৈনিক গড়ে ৫০ টাকার মতো আয় করে। সাধারণত টোকাইদের কোনো কাজে দক্ষতা থাকে না।

টোকাইরা কখনও স্বাধীনভাবে আবার কখনও দলবদ্ধভাবে কাজ করে। বিক্রি করে দু’পয়সা আয়ের জন্য এরা ডাস্টবিন, ফুটপাথ, রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশের নর্দমা, আবর্জনা নিক্ষেপের স্থান অথবা অন্যান্য জায়গা থেকে ভাঙা কাচের টুকরা, বাতিল কাগজ, শিশি বোতল, লোহা, প্লাস্টিক দ্রব্য প্রভৃতি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করে থাকে। পিঠে পাটের বস্তা নিয়ে তাতে টোকাইরা এ সকল সংগৃহীত জিনিসগুলি রাখে। একসময় বস্তাটি ভর্তি হয়ে ভারি হয়ে গেলে তারা ভাঙারির দোকানে গিয়ে এগুলি বিক্রি করে দেয়। এ সকল বাতিল জিনিসগুলির কোনো নির্ধারিত মূল্য না থাকায় এরা প্রায়ই ঠকে থাকে।

পয়সার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা টোকাইদের মিছিল, হরতালের পিকেটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করে থাকে। দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং কিশোর বয়সের হওয়ায় টোকাইরা প্রায়ই বিভিন্ন অপরাধমূলক এবং অনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহূত হয়ে থাকে। কখনও কখনও মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক বিক্রয়ে টোকাইদের কাজে লাগিয়ে থাকে।

বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টোকাইদের ভাগ্য উন্নয়নে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সরকারি সাহায্যপুষ্ট সংস্থা ইউসেপ (Under Privileged Children’s Education Programme) ১৯৭৩ সাল থেকে ঢাকা শহরে এসব ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইউসেপ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও কিশোরদের ৪ বছর সময়কাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি তাদের কারিগরি শিক্ষা প্রদান করে থাকে। পরবর্তীতে ঢাকা শহরের বাইরেও ইউসেপ-এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। কলকারখানায় কর্মরত এবং পথেঘাটের শিশু-কিশোরদের কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮০ সালের শেষের দিকে পথকলি ফাউন্ডেশন নামে অন্য আরেকটি সরকারি সাহায্যপুষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পথকলি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।  [নাজনীন আফরোজ হক]