টকি

টকি (Talkie)  বায়োস্কোপের অনুকরণ। আঞ্চলিক ভাষায় একে টকি বলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আবিষ্কৃত নির্বাক ছবির এ বায়োস্কোপে প্রযুক্তির বিকাশের সাথে এক পর্যায়ে কথা সংযোজিত হয়। তখন এর নাম হয় টকি (Talkie)। কালক্রমে টকি নাচ, গান, নাটক আর যাত্রাপালার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে স্থান করে নেয়।

টকি

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে টকি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। যে কোনো জটিল বিষয়কে সহজ-সরল ও আকর্ষণীয়ভাবে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে এর বিকল্প নেই। তাই নিরক্ষর, পিছিয়ে পড়া গ্রাম্য মানুষের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ। বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর দারুণ আকর্ষণ রয়েছে।

টকির উদ্ভাবনের মূলে রয়েছে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর শতবর্ষের সম্মিলিত প্রয়াস। ফ্রান্সের বিজ্ঞানী নিসেফোর নিপকে ১৮১৬ সালে ফটোগ্রাফিক ইমেজ আবিষ্কার করেন। ১৮৩০ সালে ফক্স ট্যালবট আবিষ্কার করেন নেগেটিভ। এসব আবিষ্কারের সূত্র ধরে লুই দ্যগুয়ের ১৮৩৭ সালে সার্থক ফটোগ্রাফি উদ্ভাবন করেন। ১৮৪৬ সালে উইলিয়াম ফ্রিজ গ্রিনি কর্তৃক সেলুলয়েড ফিল্ম আবিষ্কার চলচ্চিত্র প্রযুক্তি বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চলচ্চিত্র আবিষ্কার সম্পূর্ণরূপ পায় ১৮৯০ সাল-এর পর।

প্রথমদিকে চলচ্চিত্রে কথা সংযোজন করা সম্ভব হতো না। কিন্তু এ নির্বাক চলচ্চিত্র নিয়েই কৌতূহলের অন্ত ছিল না। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম এ ধরনের নির্বাক বায়োস্কোপ দেখানো হয় কলকাতায় ১৮৯৬ সালে। স্টিফেন্স নামে এক বিদেশি ছিলেন এ বায়োস্কোপ দেখানোর উদ্যোক্তা। স্টিফেন্স কলকাতার একটি থিয়েটার দলের সাথে ঢাকায় এসে ১৮৯৬-৯৭ সালে বায়োস্কোপ দেখিয়ে যান বলে জানা যায়। স্টিফেন্সের অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন ১৮৯৮ সালে এদেশে বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টকি ছবি দেখানো শুরু করেন।

ছায়াছবির গোড়ার দিকে এক ধরনের বায়োস্কোপ পিপ-শো বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল। গ্রামে-গঞ্জে এ পিপ-শো এখনও দেখা যায়। একজন লোকের সুরেলা গানের সাথে একটা চোঙাওয়ালা বাক্সে দর্শকরা চোখ লাগিয়ে নানা ছবি দেখতে পায়। বাক্সের ভিতর পর্দার উপর বিভিন্ন ছবি আটকানো থাকে। ক্যামেরায় তোলা স্থিরচিত্র বা হাতে অাঁকা ছবি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

পরবর্তীকালে শব্দ সংযোজনের মাধ্যমে বায়োস্কোপ তথা চলচ্চিত্র নির্বাক অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে টকি নামে গণমানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করে। ১৯২৮ সালে মেলোডি অব লাভ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উপমহাদেশের দর্শকরা প্রথম বারের মতো সবাক ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়।

বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি টকি হিসেবে মূলত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হতো। ১৯৪৮ সালে তৈরিকৃত পূর্ব পাকিস্তানে ১০ দিন (ইন আওয়ার মিডস্ট) এবং ১৯৫৪ সালে তৈরি সালামত প্রামাণ্য চিত্রের সাফল্যের মাধ্যমে টকি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৫৫ সালে চলচ্চিত্র বিভাগ এবং ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার ফলে এ ধরনের প্রামাণ্য চিত্র তৈরির পথ সুগম হয়। সাধারণত সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে তৈরি এসব প্রামাণ্য চিত্র (টকি) জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে প্রদর্শিত হতো। বর্তমানে  গণযোগাযোগ অধিদপ্তর জেলা তথ্য অফিসগুলির মাধ্যমে সারা দেশে এসব টকি প্রদর্শন করে থাকে।  পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি,  পশুসম্পদ, মৎস্য, বন প্রভৃতি বিভাগও নিজেদের কার্যক্রম প্রচারের জন্য প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করে থাকে। অনেক বেসরকারি সংস্থাও সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণে এ ধরনের প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করে।

নিয়মিতভাবে ফিল্ম শো আয়োজন করার জন্য জেলা তথ্য অফিসে একজন ফিল্ম অপারেটর রয়েছেন। তিনি জেনারেটর, প্রজেক্টর, টানানো পর্দা প্রভৃতিসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে টকি প্রদর্শনের আয়োজন করেন। এসব টকির বিষয়বস্ত্ত হয়ে থাকে সাধারণত উন্নয়ন কর্মকান্ড, জাতীয় ঘটনা বা বিশেষ দিবসের ওপর প্রামাণ্য চিত্র, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের ওপর সংবাদচিত্র প্রভৃতি। মাসের প্রথমে জেলা তথ্য অফিসার জেলার বিভিন্ন স্থানে ফিল্ম শো আয়োজনের একটি সূচি তৈরি করেন। এ সূচির অনুলিপি জেলার বিভিন্ন কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারের নিকট প্রেরণ করা হয়। এতে স্থানীয় জনগণ পূর্ব থেকেই ফিল্ম শো আয়োজনের কথা জানতে পারে। ফিল্মের বিষয়বস্ত্তর সাথে মিল রেখে অনেক ক্ষেত্রে বক্তৃতারও আয়োজন করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞ ব্যক্তি সিনেমার ফাঁকে ফাঁকে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। তিনি দর্শক-শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন। আর এভাবেই সাধারণ মানুষ বিনোদনের পাশাপাশি অনেক কিছু জানার সুযোগ পায়।

গণতান্ত্রিক সমাজে যেকোনো কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। মোটিভেশন বা সোশ্যাল মোবিলাইজেশন কথাটি আজ খুব বেশি করে শোনা যায়। এ লক্ষ্য সাধনে জনগণের সামনে সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরতে হয়। সেক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভির মতো গণমাধ্যমের চেয়ে এসব টকি অনেক বেশি কার্যকর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, স্যানিটেশন, কৃষি, বৃক্ষরোপণ, পশুপালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য সময়মতো জনগণের দোরগোড়ায় উপস্থিত করা যায়। আর তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ, ইপিআই, খাবার স্যালাইন প্রভৃতি কর্মসূচিতে টকি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর কারণ এটির ‘টার্গেট গ্রুপ’ আকর্ষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতা। উপর্যুক্ত বিষয়ে কোনো মেসেজ গ্রামের সহজ-সরল জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে হলে আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম-এর চেয়ে টকি এখনও অনেক বেশি শক্তিশালী মাধ্যম।

এই শক্তিশালী মাধ্যমটির কার্যক্রম দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলেও কারিগরি দিক থেকে টকি পূর্বতন অবস্থায়ই রয়ে গেছে; পুরানো আমলের জেনারেটর, প্রজেকটর, ১৬ মিমি ফিল্ম, টানানো পর্দা ইত্যাদি বিরাট বহর নিয়ে এখনও তার কাজ চলছে। জেনারেটরের কান ফাটানো শব্দ, যখন তখন বন্ধ হয়ে যাওয়া, ল্যাম্প ফিউজ হওয়া, অস্পষ্ট কথা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে অপারেটরকে প্রায়ই দর্শকদের রোষানলে পড়তে হয়। অনেকে এ ধরনের ছবির বিষয়বস্ত্ততে রাজনৈতিক গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করে। প্রদর্শনীতে দিন দিন নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির সাথে সাথে মাস্তানদের দৌরাত্ম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই ফিল্ম শো-তে নিরাপত্তা এখন একটি উদ্বেগের বিষয়। সমন্বয়হীনতা ‘ফিল্ম শো’র আরেকটি বড় সমস্যা। স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ প্রভৃতি সব বিভাগই কিছু কিছু ছবি তৈরি করে থাকে। কিন্তু এ ছবিগুলি একেবারেই বিষয়ভিত্তিক। পুরো ছবি জুড়ে থাকে শুধু মাছ চাষ বা বৃক্ষরোপণ বা পরিকল্পিত পরিবার গঠনের কথা। একই বিষয়ে বেশিক্ষণ এ ধরনের ছবি দেখতে অনেকে বিরক্তি বোধ করেন। আর বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি এ ধরনের ছবি দেখার সময় ও সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না। তাছাড়া একজন ব্যক্তির জীবন বিচ্ছিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ভিত্তিক নয়। একজন কৃষকের যেমন আছে ধানক্ষেত, পুকুর, হাঁস-মুরগি, গরু-বাছুর তেমনি রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্যানিটেশন সমস্যাও। এ সবগুলির সমন্বয়ে তৈরি ছবিই তার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। [এম. সাইফুল্লাহ]