ঝুমুর গান

ঝুমুর গান  প্রাচীন ধারার লোকসঙ্গীত। আদিতে তা আদিবাসী, বিশেষ করে সাঁওতালদের গান ছিল; এখনও তাদের মধ্যে এ গানের জনপ্রিয়তা রয়েছে। ঝুমুর নাচ ও গান এক সঙ্গে পরিবেশিত হয়। সাঁওতালরা করম উৎসবে ঝুমুর নাচ-গান একত্রে পরিবেশন করে থাকে। প্রেমভাব ও সুরের লালিত্যে ঝুমুর গান বাংলার সাধারণ শ্রেণীর মানুষের মধ্যেও বিস্তার লাভ করেছে। বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র আঙ্গিকে লোক-প্রচলিত ঝুমুর ও ধামালী গানের প্রভাব আছে। দুই চরিত্রের মধ্যে সম্বন্ধ পাতিয়ে সংলাপ ঝুমুর গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা, কৃষ্ণ, বড়ায়ির এরূপ বহু উক্তি-প্রত্যুক্তি আছে। পরবর্তীকালে রচিত বৈষ্ণবপদে ‘ঝুমরী’ গানের উল্লেখ আছে- ‘ঝুমরী গাইছে শ্যাম বাঁশী বাজাইয়া।’ ‘পদকল্পতরু’র একটি পদে আছে- ‘যুবতী যূথ শত গায়ত ঝুমরী।’ লৌকিক ঝুমুর গানে বৈষ্ণবপদাবলীর রীতি মান্য হলেও ঝুমুরের গায়কী ধারা ভিন্ন। শান্তি সিংহ বলেন, ‘‘ঝুমুরের গায়নরীতি মূলত অবরোহনধর্মী। চড়ার দিকে অনেকখানি গিয়ে ক্রমশ নেমে আসা হয় বক্রগতিতে। পরিশেষে খাদে এসে একটি পদে স্থিতিলাভ হয়। ঝুমুরের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল- গায়নরীতি অবরোহনক্রমে হলেও গানের চড়া ও খাদের ভারসাম্য সঠিকভাবে থাকে।... এই গায়কী লোকরীতির অন্তর্গত।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম ঝুমুর গানের সুর ও আঙ্গিকে একাধিক গান রচনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় ঝুমুর গানের উৎসভূমি; পরে সীমান্ত অঞ্চলে প্রসারিত হয়। বাংলাদেশের রাজশাহী ফরিদপুর জেলাতে এ গানের প্রচলন আছে। লৌকিক ঝুমুর গানের বিষয়বস্ত্ত রাধাকৃষ্ণের পার্থিব প্রেম; নেচে গেয়ে তা পরিবেশন করা হয়। উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক ঝুমুর গানে প্রচুর নাটকীয়তা আছে। পালা ঝুমুর গান লোকনাট্য বলেই বিবেচিত হয়। বৈঠকী বা ছুট ঝুমুর গান একক কণ্ঠে গীত হয়। ছুট ঝুমুর সাধারণত চার কলি বা তার সামান্য বেশি হয়। ঝুমুরের সুরে কীর্তনের আলাপের বৈশিষ্ট্য থাকলেও এতে আখরের প্রয়োগ নেই, এর পরিবর্তে ধ্রুব বা ‘রঙ’ গুরুত্ব পেয়েছে। আদিবাসীদের ঝুমুর গানের উপলক্ষ আছে- করম উৎসবে সাঁওতালি ঝুমুর নাচ-গান, পুরুলিয়ার আদিবাসীদের দাঁড়শাল ও ছৌ নৃত্যোপলক্ষে দাঁড়শালিয়া ও ছৌ ঝুমুর নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়। লোকসমাজে খেমটা নাচের সঙ্গে খেমটা ঝুমুর এবং ভাদ্র মাসে বর্ষা প্রকৃতি বন্দনা করে ভাদুরিয়া ঝুমুর গান করা হয়। সখীত্ব বা বন্ধুত্ব পাতানো উপলক্ষে নারী ও পুরুষের মধ্যে পাতা নাচের ঝুমুর প্রচলিত আছে। ঝুমুর সারি গানের অনুরূপ দ্রুত লয়ের গান। লোকসমাজে প্রচলিত একটি ঝুমুর গানের দৃষ্টান্ত:

(১) শ্যামের বাঁশী দিবানিশি,/ ওগো ডাকে নাম ধরি।

আকুল হইল প্রাণ,/ গৃহে রইতে নারি\

জ্বালা দিত বড় ভারী রে,/ বাঁশী কাল হইল। ধুয়া...

হায় আমার কি হইল,/ কি করি বল,

তিলেক না ছাড়ে দ্বার, ননন্দী প্রহরী রে,/বাঁশী কাল হইল\

(২) গাঁথিব ফুলেরই মালা, যতনে সাজাব কালা,

আমি ঘুচাইব মনের জ্বালা, দুঃখ যাবে দূরে।

বন্ধু, হূদয় মাজারে শ্যামকে রাখিব আদরে\ ধুয়া

না আইলে নন্দলাল কেমনে মিটাব জ্বালা।

থাক থাক প্রাণবল্লভ বাঁধা প্রেম-ডোরে।

হূদয়-মন্দিরে শ্যামকে রাখিব আদরে\- মেদেনীপুর

[ওয়াকিল আহমদ]