জ্যোতিষ
জ্যোতিষ পার্থিব ঘটনাসমূহের পূর্বাভাস প্রদানের উদ্দেশ্যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সংক্রান্ত বিদ্যা। এ বিদ্যার চর্চা প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র প্রচলিত ছিল। পাশ্চাত্য ও ভারতীয় জ্যোতিষ সৌরপথের ১২টি চিহ্নের ভিত্তিতে গঠিত, কিন্তু চীনা জ্যোতিষ ষাট বছরের একটি ঘটনাচক্র এবং চান্দ্র বর্ষপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট জ্যোতিষ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের বিভিন্ন কাজে, যেমন যাত্রার শুভক্ষণ নির্ধারণ, জমিচাষ আরম্ভ, বীজ বপন করা, নতুন ব্যবসায় শুরু করা ইত্যাদি ব্যাপারে গণক বা জ্যোতিষীর পরামর্শ নেওয়া হয়। হিন্দুদের বিবাহের ক্ষেত্রে জ্যোতিষীর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতিষী জন্মের সময় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচারপূর্বক নবজাতকের কোষ্ঠী তৈরি করেন। যখন বিয়ের আয়োজন করা হয় তখন প্রত্যাশিত বর ও কনের উপযুক্ততা বিচারের জন্য তাদের দুজনের কোষ্ঠী তুলনা করা হয়। বিবাহের যথার্থ সময় (লগ্ন) নির্ধারণের জন্যও জ্যোতিষীর পরামর্শ নেওয়া হয়। জ্যোতিষীর পরামর্শ অনুযায়ী লগ্ন যদি গভীর রাতেও হয় তথাপি সেটাই অনুসরণ করা হয়।
ভারতবর্ষের রাজা এবং সম্রাটদের দরবারে এক সময় জ্যোতিষীদের খুব সম্মান ছিল। কিংবদন্তি আছে, জনৈক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, লক্ষ্মণসেনের রাজ্য অচিরেই একজন মুসলমান আক্রমণকারী কর্তৃক বিজিত হবে। বাস্তবেও দেখা যায় লক্ষ্মণসেন বখতিয়ার খিলজির আগমনের খবর পেয়ে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনা জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করে। মুগলদেরও জ্যোতিষী ছিল। নজুম নামে পরিচিত একজন জ্যোতিষীর উপদেশ ছাড়া শাহী পরিবারের কোনো বিয়ে হতো না।
ঝালকাঠি গ্রামে ‘পাঁজি পুথি পাড়া’ নামে একটি জায়গা আছে। মুগল আমলে সেখানে একজন জ্যোতিষীর বাস ছিল বলে একটি জনপ্রিয় লোককাহিনী প্রচলিত আছে। এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও গণক টুলি (জ্যোতিষীদের এলাকা) নামে একটি এলাকা রয়েছে।
পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় জ্যোতিষের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পাশ্চাত্য জ্যোতিষ সূর্যভিত্তিক। এখানে সূর্যোদয়ের সময়কে একটি চিহ্ন বা রাশি বলা হয়। যেমন ২১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সূর্যোদয়ের চিহ্ন মেষরাশি। এ সময় যার জন্ম হয় তার রাশি হয় মেষ। জ্যোতিষ গণনায় ভারতীয় পদ্ধতিতে চন্দ্রকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। চন্দ্র এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে অবস্থান পরিবর্তন করে আড়াই দিনে। এভাবে চন্দ্র এক মাসের মধ্যে সৌরপথের বারোটি চিহ্ন বা রাশিই অতিক্রম করে। ভারতীয় জ্যোতিষে ২৭টি নক্ষত্রপূঞ্জকেও বিবেচনা করা হয়। জ্যোতিষী কারও কোষ্ঠী নির্ণয়ে তার জন্মচিহ্ন (চন্দ্রচিহ্ন) এবং জন্মনক্ষত্র উভয়ই বিবেচনা করেন।
যদিও অনেকেই বর্তমানে জ্যোতিষতত্ত্বে বিশ্বাস করেন না, তথাপি বাংলাদেশের বহু সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে আসন্ন সপ্তাহের রাশিফল প্রচার করা হয়; এমনকি দৈনিক পত্রিকাগুলিতেও প্রতিদিনের রাশিফল মুদ্রিত হয়। আবার অনেক আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তিকেও জ্যোতিষীর উপদেশ অনুসারে গ্রহ-নক্ষত্রের অশুভ প্রভাব প্রতিহত করার জন্য মূল্যবান পাথর ব্যবহার করতে দেখা যায়। [এ.আর হাওলাদার]