জৈবগ্যাস

জৈবগ্যাস (Biogas)  বাতাসের অনুপস্থিতিতে জৈববস্ত্তর অণুজীবীয় ভাঙনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস। প্রধানত মিথেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর সমন্বয়ে এ গ্যাস গঠিত। এ জৈবিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া অবায়বীয় (anaerobic) পরিপাক বা জারণ হিসেবে অধিক পরিচিত এবং অনুজীবীয় মিথেন উৎপাদন প্রক্রিয়া (microbial methanogenesis) জৈববস্ত্তর অবায়বীয় পরিপাকের সময় সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রথাগতভাবে মিথেন উৎপাদন প্রক্রিয়াটিকে দুই ধাপ বিশিষ্ট একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার প্রথম ধাপে উৎপন্ন হয় এসিড গঠনকারী ব্যাকটেরিয়া যারা জৈব উপাদানসমূহকে আর্দ্র-বিশ্লেষণ ও গাঁজনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গাঁজন দ্রব্য যেমন - বিভিন্ন জৈব এসিড, অ্যালকোহল, প্রশমিত যৌগ, হাইড্রোজেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে। দ্বিতীয় ধাপে উৎপন্ন হয় মিথেন গঠনকারী ব্যাকটিরিয়া যারা এসকল গাঁজন দ্রব্যকে মিথেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডে রূপান্তর করে।

বাংলাদেশের জ্বালানি শক্তি ব্যবহারের দিকে তাকালে দেখা যায়, দেশিয় সনাতন জ্বালানি শক্তি উৎসগুলো যেমন, শস্য অবশেষ (৪০.৯%), গোবর (১৪.৩%) এবং জ্বালানি কাঠ (৮.৭%) মোট শক্তি খরচের ৬৩.৯ শতাংশ দখল করে আছে। ১৯৮৩-১৯৮৪ সালের গবাদিপশু জরিপ অনুযায়ী মোট বাৎসরিক গোবর (শুকনা গোবর) উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১.১৬ কোটি টন, যার ৩১% ঘুঁটে হিসেবে সরাসরি জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয় এবং ৬৮% সার হিসেবে জমিতে প্রয়োগ করা হয়েছিল, আর অবশিষ্ট এক শতাংশ ব্যবহার করা হয় অন্যান্য প্রয়োজনে। জ্বালানি হিসেবে সরাসরি গোবর পোড়ানো একদিকে যেমন গোবরসারের ঘাটতি সৃষ্টি করে, তেমনি অন্যদিকে পরিবেশের দূষণ ঘটায়। অবায়বীয় পরিপাকের মাধ্যমে জৈবগ্যাসের উৎপাদন শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য ও দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের নিশ্চয়তাই দেয় না, সেই সঙ্গে বর্জ্যকে সার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

বায়োগ্যাস উৎপাদনে যেসব সাধারণ উপাদান প্রভাব বিস্তার করে থাকে সেগুলো হচ্ছে মূল জৈববস্ত্তসমূহের ধরন, তাপমাত্রা, ঘনদ্রবণ ও দ্রাবকের পি.এইচ (pH) মাত্রা। যে সমস্ত জৈববস্ত্ততে ২০:১ থেকে ২৫:১ মাত্রা পর্যন্ত অ-লিগনীন C:N উপাদান রয়েছে সেগুলো জৈবগ্যাস উৎপাদনের জন্য উৎকৃষ্ট। ২০:১ মাত্রার C:N অনুপাতযুক্ত গোবর জৈবগ্যাস উৎপাদনের জন্য উপযোগী বলে বিবেচিত। জৈবগ্যাস উৎপাদনে অবায়বীয় পরিপাক প্রক্রিয়া ১০°  থেকে ৩৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রা পরিসরের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে এবং কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা পরিসর হচ্ছে ৩৩° থেকে ৩৫° সে। কাঙ্ক্ষিত পি.এইচ মাত্রার পরিসর হচ্ছে ৬.৫ থেকে ৭.৫ এবং ঘনবস্ত্তর পরিমাণ ৮ থেকে ১২ শতাংশ। জৈবসার প্রস্ত্ততের জন্য উপাদান সমূহের নির্দেশিত মান হচ্ছে - গোবর ও পানির ১:১ অনুপাতের মিশ্রণের সঙ্গে ১৮% থেকে ২০% পরিমাণ ঘনবস্ত্ত যা পরিণামে ঘনবস্ত্তর পরিমাণকে ৯ থেকে ১০ শতাংশে দাঁড় করায়। তরল বর্জ্যের ধীর মিশ্রণ বা আন্দোলন জৈবগ্যাসের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে থাকে।

বাংলাদেশে জৈবগ্যাস প্রযুক্তি উন্নয়নের সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে গবাদি পশুর মোট সংখ্যা প্রায় ২,৪১,৯০,০০০ যা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪,২০,০০,০০০ কিলোগ্রাম বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ পরিমাণ পশুবর্জ্য থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩.১৯ × ১০ল৯ ঘনমিটার জৈবগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। যদি মোট পশুবর্জ্যের ৫০ শতাংশও জৈবগ্যাস উৎপাদনে ব্যবহূত হয়, তাহলে দেশে ৩ ঘনমিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় ১৩,৬০,০০০ জৈবগ্যাস উৎপাদক যমত্র স্থাপন করা সম্ভব। তিন ঘনমিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জৈবগ্যাস উৎপাদক যমত্র ৭-৮ সদস্যের একটি পরিবারে রান্না ও আলোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম এবং এজন্য প্রয়োজন হবে ৬০ থেকে ৭০ কিলোগ্রাম গোবর যা ৫-৬টি গরু অথবা ৩-৪টি মহিষ থেকে পাওয়া যেতে পারে। শক্তি সরবরাহ ছাড়াও জৈবগ্যাস উৎপাদনের পর ব্যবহূত পশুবর্জ্যকে সার হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

সত্তর দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (Bangladesh Council of Scientific and Industrial Research - BCSIR) বা সায়েন্স ল্যাবরেটরির যৌথ উদ্যোগে জৈবগ্যাস প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং গৃহস্থালীতে ব্যবহার উপযোগী আকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র নির্মাণের ওপর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৬ সালে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে প্রথম ৩ ঘনমিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন গৃহস্থালিতে ব্যবহার উপযোগী জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র স্থাপন করা হয় এবং সেটি ছিল একটি ভাসমান গম্বুজাকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র। ভাসমান গম্বুজ আকারের এ নমুনা জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্রটি ছিল মূলত মাটির নিচে তৈরি ইটের গাঁথুনির সিলিন্ডার আকৃতির একটি পাত্র যার উপরে ও নিচে ছিল দুটি প্রকোষ্ঠ এবং সিলিন্ডারের তলা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া একটি প্রবেশ নল ও একটি নির্গম নল। উপরের প্রকোষ্ঠটি বর্জ্যের উপর ভাসমান একটি গ্যাসপ্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত যেটি লোহার পাত দিয়ে তৈরি। গ্যাসপ্রকোষ্ঠ থেকে নমনীয় রাবারের পাইপ ও লোহার পাইপের সাহায্যে সরাসরি রান্নাঘরের চুলায় জৈবগ্যাস নিয়ে যাওয়া হয়। এ ধরনের একটি জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র স্থাপনে মোট ব্যয় হতো ১২,০০০ টাকা। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মাত্র ৩,০০০ টাকায় ৩ ঘনমিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন গম্বুজাকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র তৈরি করতে সমর্থ হয়। রান্নার জন্য জ্বালানি সংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরির ইনস্টিটিউট অব ফুয়েল রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর তত্ত্বাবধানে ২১৪টি ভাসমান গম্বুজাকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র স্থাপিত হয়। কিন্তু এসকল যন্ত্রের গ্যাস-হোল্ডারে ছিদ্র থাকায় যন্ত্রগুলো মাত্র ৩ থেকে ৫ বছর কার্যক্ষম ছিল।

এই ছিদ্র সমস্যার কারণে সায়েন্স ল্যাবরেটরি ১৯৯১ সালে একই ক্ষমতাসম্পন্ন গৃহস্থালিতে ব্যবহারের উপযোগী স্থির গম্বুজাকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র তৈরি করে। এ ধরনের জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র আকৃতিতে কিছুটা ভিন্ন এবং পুরো যন্ত্রটাই মাটির নিচে থাকে। মাটি খুঁড়ে ইটের গাঁথুনি দিয়ে গ্যাস উৎপাদক তৈরি করা হয় এবং ঢালাই সিমেন্ট অথবা ইট দিয়ে ঢাকনা তৈরি করা হয়। নির্মাণ পদ্ধতি যাই হোক না কেন এ ধরনের জৈবগ্যাস উৎপাদন যন্ত্রের বেলায় সিমেন্ট অথবা বিভিন্ন ধরনের মসলামিশ্রিত গোলা দ্বারা সামগ্রিক জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্রকে পানি ও গ্যাস নিরোধক করে তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। উপরের ঢাকনাটিও অবশ্যই সুগঠিত এবং গ্যাস নিরোধক হতে হবে। এক পাশের পাইপের মাধ্যমে কাঁচামাল প্রবেশ করানো হয় এবং অন্য পাশের পাইপ থেকে বালতির মাধ্যমে ব্যবহূত অবশেষ বের করা হয়।

একটি সাধারণ আকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্র ৩ ঘনমিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। পাঁচ থেকে ছয়টি গবাদিপশু রয়েছে এমন একটি মধ্যম আকারের কৃষক পরিবারের দৈনন্দিন জ্বালানির প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাধারণ আকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্রই যথেষ্ট। অধিকতর বৃহৎ গো-খামারের ক্ষেত্রে বড় আকৃতির জৈবগ্যাস উৎপাদক যন্ত্রও নির্মাণ করা যায় এবং উৎপন্ন গ্যাস প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।  [বি.কে বালা]