জুমচাষ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''জুমচাষ''' (Jhum)  বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি। এর প্রকৃত অর্থ হলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা। এ ধরনের চাষাবাদে শুষ্ক মৌসুমে বনভূমি কেটে বা পুড়িয়ে স্বল্পসময়ের জন্য (১-৩ বছর) ফসল চাষাবাদের পর প্রাকৃতিক বনভূমির পুনর্জন্ম ও মৃত্তিকার উর্বরতার ক্ষয়পূরণের জন্য দীর্ঘসময় (১০-৪০ বছর) পতিত রাখা হয়।
'''জুমচাষ''' (Jhum)  বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি। এর প্রকৃত অর্থ হলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা। এ ধরনের চাষাবাদে শুষ্ক মৌসুমে বনভূমি কেটে বা পুড়িয়ে স্বল্পসময়ের জন্য (১-৩ বছর) ফসল চাষাবাদের পর প্রাকৃতিক বনভূমির পুনর্জন্ম ও মৃত্তিকার উর্বরতার ক্ষয়পূরণের জন্য দীর্ঘসময় (১০-৪০ বছর) পতিত রাখা হয়।


[[Image:JhumCultivation.jpg|thumb|400px|right|জুমচাষ: রোপণ পদ্ধতি]]
জুম বা স্থানান্তর চাষাবাদ সাধারণভাবে ‘সুইডেন চাষাবাদ’ বা জঙ্গল পরিষ্কার ও পোড়ানো চাষাবাদ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের প্রাচীন চাষাবাদ অধিকাংশ উপজাতীয় অধিবাসীদের অতি পরিচিত। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে ঢালু পাহাড়ের ওপর জুমচাষ করা হয়। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ হেক্টর ভূমি জুমচাষের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, এতে প্রতি হেক্টর ভূমিতে ১০০ থেকে ২৫০ মে টন মাটি ক্ষয় হয়।
জুম বা স্থানান্তর চাষাবাদ সাধারণভাবে ‘সুইডেন চাষাবাদ’ বা জঙ্গল পরিষ্কার ও পোড়ানো চাষাবাদ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের প্রাচীন চাষাবাদ অধিকাংশ উপজাতীয় অধিবাসীদের অতি পরিচিত। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে ঢালু পাহাড়ের ওপর জুমচাষ করা হয়। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ হেক্টর ভূমি জুমচাষের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, এতে প্রতি হেক্টর ভূমিতে ১০০ থেকে ২৫০ মে টন মাটি ক্ষয় হয়।


জুমচাষের নিবিড়তা বৃষ্টিপাত, ভূমির বন্ধুরতা, অভিগম্যতা ও জনসংখ্যার ঘনত্বের পার্থক্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ চাষপদ্ধতির উপর নির্ভরতা ভিত্তি করে জুমিয়া পরিবারকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় ১. সার্বিকভাবে নির্ভরশীল, ২. আংশিকভাবে নির্ভরশীল ও ৩. প্রান্তিকভাবে নির্ভরশীল। জুম উপজাতীয়দের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় জুমচাষে তাদের অনুসৃত পদ্ধতি স্থানভেদে এবং কৃষকদের শ্রেণীভেদেও পৃথক হয়। মূলত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয়দের জীবন ও সংস্কৃতি বহুলাংশে জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া সিলেটের পাহাড়িয়া অঞ্চলেও কিছু কিছু জুমচাষ হয়।  
জুমচাষের নিবিড়তা বৃষ্টিপাত, ভূমির বন্ধুরতা, অভিগম্যতা ও জনসংখ্যার ঘনত্বের পার্থক্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ চাষপদ্ধতির উপর নির্ভরতা ভিত্তি করে জুমিয়া পরিবারকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় ১. সার্বিকভাবে নির্ভরশীল, ২. আংশিকভাবে নির্ভরশীল ও ৩. প্রান্তিকভাবে নির্ভরশীল। জুম উপজাতীয়দের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় জুমচাষে তাদের অনুসৃত পদ্ধতি স্থানভেদে এবং কৃষকদের শ্রেণীভেদেও পৃথক হয়। মূলত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয়দের জীবন ও সংস্কৃতি বহুলাংশে জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া সিলেটের পাহাড়িয়া অঞ্চলেও কিছু কিছু জুমচাষ হয়।
 
[[Image:JhumCultivation.jpg|thumb|400px|জুমচাষ: রোপণ পদ্ধতি]]


পৌষ-মাঘ মাসে সুবিধাজনক সময়ে চাষের জন্য এক টুকরো জঙ্গল নির্বাচন করা হয়। জমি নির্বাচনের সময় গাছ, বাঁশ ও আগাছাসহ পাহাড়ের গায়ের ঢালু জায়গাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তারপর সেই জঙ্গলের সমস্ত গাছ, বাঁশ, ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। কাটার পর সেগুলি রোদে শুকানো হয় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাধারণত চৈত্র ও বৈশাখের শুরুতে এতে আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সঙ্গে ওপরের ১-২ ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। ছাই ও পোড়ামাটির জন্য জমি উর্বর হয়। এরপর দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তারপর বীজ বোনার কাজ শুরু হয়।
পৌষ-মাঘ মাসে সুবিধাজনক সময়ে চাষের জন্য এক টুকরো জঙ্গল নির্বাচন করা হয়। জমি নির্বাচনের সময় গাছ, বাঁশ ও আগাছাসহ পাহাড়ের গায়ের ঢালু জায়গাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তারপর সেই জঙ্গলের সমস্ত গাছ, বাঁশ, ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। কাটার পর সেগুলি রোদে শুকানো হয় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাধারণত চৈত্র ও বৈশাখের শুরুতে এতে আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সঙ্গে ওপরের ১-২ ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। ছাই ও পোড়ামাটির জন্য জমি উর্বর হয়। এরপর দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তারপর বীজ বোনার কাজ শুরু হয়।
১২ নং লাইন: ১২ নং লাইন:
চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের অনুষ্ঠানের পর সাধারণত জমিতে ফসল বোনার উৎসব শুরু হয়। এ সময় পরিবারের সবাই মিলে বীজ বোনার কাজ শুরু করে। সাধারণভাবে জন্মানো প্রধান ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, কাউন, তিল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ, বরবটি, তুলা, কলা, আদা, হলুদ প্রভৃতি। বীজ বপনের জন্য ‘দা’ নামে সাধারণভাবে পরিচিত একটি প্রশস্ত ব্লেডের ছুরি ব্যবহূত হয়। বাঁ হাতে দা-এর মাথা দিয়ে মাটি ফাঁক করে তাতে একত্রে মেশানো বীজ পরিমাণ মতো ডান হাত দিয়ে ঢেলে দেওয়া হয়। তারপর দা তুলে নিলে মাটিতে আপনা আপনি বীজগুলি ঢেকে যায়। এ বপনপদ্ধতি আদিম। এ চাষপদ্ধতিতে ফসল পেতে হলে খুব পরিশ্রম করতে হয়। বিশেষ করে ধান কাটার সময় অন্য যেসব ফসলের চারাগাছ থাকে, তার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। জুমচাষে বন্য পশুপাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা ব্যতীত কদাচিৎ আগাছা দমন করা হয়। বিভিন্ন ফসল আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যবর্তী সময়ে পরিপক্ক হয় এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলি সংগ্রহ করা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের অনুষ্ঠানের পর সাধারণত জমিতে ফসল বোনার উৎসব শুরু হয়। এ সময় পরিবারের সবাই মিলে বীজ বোনার কাজ শুরু করে। সাধারণভাবে জন্মানো প্রধান ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, কাউন, তিল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ, বরবটি, তুলা, কলা, আদা, হলুদ প্রভৃতি। বীজ বপনের জন্য ‘দা’ নামে সাধারণভাবে পরিচিত একটি প্রশস্ত ব্লেডের ছুরি ব্যবহূত হয়। বাঁ হাতে দা-এর মাথা দিয়ে মাটি ফাঁক করে তাতে একত্রে মেশানো বীজ পরিমাণ মতো ডান হাত দিয়ে ঢেলে দেওয়া হয়। তারপর দা তুলে নিলে মাটিতে আপনা আপনি বীজগুলি ঢেকে যায়। এ বপনপদ্ধতি আদিম। এ চাষপদ্ধতিতে ফসল পেতে হলে খুব পরিশ্রম করতে হয়। বিশেষ করে ধান কাটার সময় অন্য যেসব ফসলের চারাগাছ থাকে, তার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। জুমচাষে বন্য পশুপাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা ব্যতীত কদাচিৎ আগাছা দমন করা হয়। বিভিন্ন ফসল আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যবর্তী সময়ে পরিপক্ক হয় এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলি সংগ্রহ করা হয়।


জুমচাষের জন্য পর্যাপ্ত ভূমি পাওয়া যেত বলে এর মূল কৌশল হিসেবে প্রাকৃতিক অরণ্য সৃষ্টির জন্য দীর্ঘসময় অনাবাদি রাখা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অনাবাদি সময়কাল প্রথাগত দশ বছর থেকে বিপজ্জনকভাবে দুই থেকে তিন বছরে হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ জনসংখ্যার চাপ ও কাপ্তাই জলাধারের কারণে কৃষি জমির হ্রাস, এবং ব্যাপকহারে অ-উপজাতিদের বসতি স্থাপন। জুমচাষ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। জুমচাষের ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয়, বন উজাড়, বন্য পশুপাখির আবাসস্থল ধ্বংস এবং নদী ও হ্রদসমূহ ভরাট হওয়া। ফলে উৎপাদন ক্রমে এতই হ্রাস পায় যে একটি জুমিয়া পরিবার এক জায়গায় টিকে থাকতে পারে না। ব্যাপকভাবে অনুসৃত সর্বনিম্ন ৭-৮ বছর আবর্তনচক্র বর্তমানে ৩-৪ বছরে হ্রাস পেয়েছে যা ক্ষয়পূরণ ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। এসব কারণে এখন শস্যের ফলন ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। তাই জুমচাষের উপযোগী বিকল্প উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি।
জুমচাষের জন্য পর্যাপ্ত ভূমি পাওয়া যেত বলে এর মূল কৌশল হিসেবে প্রাকৃতিক অরণ্য সৃষ্টির জন্য দীর্ঘসময় অনাবাদি রাখা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অনাবাদি সময়কাল প্রথাগত দশ বছর থেকে বিপজ্জনকভাবে দুই থেকে তিন বছরে হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ জনসংখ্যার চাপ ও কাপ্তাই জলাধারের কারণে কৃষি জমির হ্রাস, এবং ব্যাপকহারে অ-উপজাতিদের বসতি স্থাপন। জুমচাষ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। জুমচাষের ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয়, বন উজাড়, বন্য পশুপাখির আবাসস্থল ধ্বংস এবং নদী ও হ্রদসমূহ ভরাট হওয়া। ফলে উৎপাদন ক্রমে এতই হ্রাস পায় যে একটি জুমিয়া পরিবার এক জায়গায় টিকে থাকতে পারে না। ব্যাপকভাবে অনুসৃত সর্বনিম্ন ৭-৮ বছর আবর্তনচক্র বর্তমানে ৩-৪ বছরে হ্রাস পেয়েছে যা ক্ষয়পূরণ ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। এসব কারণে এখন শস্যের ফলন ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। তাই জুমচাষের উপযোগী বিকল্প উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। [মো. শহীদুল ইসলাম এবং মো. মুকবিল হোসেন]
 
[মো. শহীদুল ইসলাম এবং মো. মুকবিল হোসেন]


[[en:Jhum]]
[[en:Jhum]]

০৬:৫৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

জুমচাষ (Jhum)  বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি। এর প্রকৃত অর্থ হলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা। এ ধরনের চাষাবাদে শুষ্ক মৌসুমে বনভূমি কেটে বা পুড়িয়ে স্বল্পসময়ের জন্য (১-৩ বছর) ফসল চাষাবাদের পর প্রাকৃতিক বনভূমির পুনর্জন্ম ও মৃত্তিকার উর্বরতার ক্ষয়পূরণের জন্য দীর্ঘসময় (১০-৪০ বছর) পতিত রাখা হয়।


জুমচাষ: রোপণ পদ্ধতি

জুম বা স্থানান্তর চাষাবাদ সাধারণভাবে ‘সুইডেন চাষাবাদ’ বা জঙ্গল পরিষ্কার ও পোড়ানো চাষাবাদ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের প্রাচীন চাষাবাদ অধিকাংশ উপজাতীয় অধিবাসীদের অতি পরিচিত। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে ঢালু পাহাড়ের ওপর জুমচাষ করা হয়। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ হেক্টর ভূমি জুমচাষের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, এতে প্রতি হেক্টর ভূমিতে ১০০ থেকে ২৫০ মে টন মাটি ক্ষয় হয়।

জুমচাষের নিবিড়তা বৃষ্টিপাত, ভূমির বন্ধুরতা, অভিগম্যতা ও জনসংখ্যার ঘনত্বের পার্থক্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ চাষপদ্ধতির উপর নির্ভরতা ভিত্তি করে জুমিয়া পরিবারকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় ১. সার্বিকভাবে নির্ভরশীল, ২. আংশিকভাবে নির্ভরশীল ও ৩. প্রান্তিকভাবে নির্ভরশীল। জুম উপজাতীয়দের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় জুমচাষে তাদের অনুসৃত পদ্ধতি স্থানভেদে এবং কৃষকদের শ্রেণীভেদেও পৃথক হয়। মূলত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয়দের জীবন ও সংস্কৃতি বহুলাংশে জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া সিলেটের পাহাড়িয়া অঞ্চলেও কিছু কিছু জুমচাষ হয়।

পৌষ-মাঘ মাসে সুবিধাজনক সময়ে চাষের জন্য এক টুকরো জঙ্গল নির্বাচন করা হয়। জমি নির্বাচনের সময় গাছ, বাঁশ ও আগাছাসহ পাহাড়ের গায়ের ঢালু জায়গাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তারপর সেই জঙ্গলের সমস্ত গাছ, বাঁশ, ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। কাটার পর সেগুলি রোদে শুকানো হয় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাধারণত চৈত্র ও বৈশাখের শুরুতে এতে আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সঙ্গে ওপরের ১-২ ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। ছাই ও পোড়ামাটির জন্য জমি উর্বর হয়। এরপর দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তারপর বীজ বোনার কাজ শুরু হয়।

চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের অনুষ্ঠানের পর সাধারণত জমিতে ফসল বোনার উৎসব শুরু হয়। এ সময় পরিবারের সবাই মিলে বীজ বোনার কাজ শুরু করে। সাধারণভাবে জন্মানো প্রধান ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, কাউন, তিল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ, বরবটি, তুলা, কলা, আদা, হলুদ প্রভৃতি। বীজ বপনের জন্য ‘দা’ নামে সাধারণভাবে পরিচিত একটি প্রশস্ত ব্লেডের ছুরি ব্যবহূত হয়। বাঁ হাতে দা-এর মাথা দিয়ে মাটি ফাঁক করে তাতে একত্রে মেশানো বীজ পরিমাণ মতো ডান হাত দিয়ে ঢেলে দেওয়া হয়। তারপর দা তুলে নিলে মাটিতে আপনা আপনি বীজগুলি ঢেকে যায়। এ বপনপদ্ধতি আদিম। এ চাষপদ্ধতিতে ফসল পেতে হলে খুব পরিশ্রম করতে হয়। বিশেষ করে ধান কাটার সময় অন্য যেসব ফসলের চারাগাছ থাকে, তার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। জুমচাষে বন্য পশুপাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা ব্যতীত কদাচিৎ আগাছা দমন করা হয়। বিভিন্ন ফসল আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যবর্তী সময়ে পরিপক্ক হয় এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলি সংগ্রহ করা হয়।

জুমচাষের জন্য পর্যাপ্ত ভূমি পাওয়া যেত বলে এর মূল কৌশল হিসেবে প্রাকৃতিক অরণ্য সৃষ্টির জন্য দীর্ঘসময় অনাবাদি রাখা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অনাবাদি সময়কাল প্রথাগত দশ বছর থেকে বিপজ্জনকভাবে দুই থেকে তিন বছরে হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ জনসংখ্যার চাপ ও কাপ্তাই জলাধারের কারণে কৃষি জমির হ্রাস, এবং ব্যাপকহারে অ-উপজাতিদের বসতি স্থাপন। জুমচাষ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। জুমচাষের ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয়, বন উজাড়, বন্য পশুপাখির আবাসস্থল ধ্বংস এবং নদী ও হ্রদসমূহ ভরাট হওয়া। ফলে উৎপাদন ক্রমে এতই হ্রাস পায় যে একটি জুমিয়া পরিবার এক জায়গায় টিকে থাকতে পারে না। ব্যাপকভাবে অনুসৃত সর্বনিম্ন ৭-৮ বছর আবর্তনচক্র বর্তমানে ৩-৪ বছরে হ্রাস পেয়েছে যা ক্ষয়পূরণ ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। এসব কারণে এখন শস্যের ফলন ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। তাই জুমচাষের উপযোগী বিকল্প উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। [মো. শহীদুল ইসলাম এবং মো. মুকবিল হোসেন]