জীবন বীমা কর্পোরেশন

জীবন বীমা কর্পোরেশন (জেবিসি)  ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর অধীনে ২০০ মিলিয়ন টাকা অনুমোদিত মূলধন নিয়ে ১৪ মে ১৯৭৩ তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মূলধন প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ২ মিলিয়ন সাধারণ শেয়ারে বিভক্ত ছিল। কর্পোরেশন-এর পরিশোধিত মূলধন ৫০ মিলিয়ন টাকা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিশোধিত। এটি ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট, ১৯৩৮; ইন্সুরেন্স রুলস্, ১৯৫৮, ইন্সুরেন্স কর্পোরেশনস রুলস, ১৯৫৮; ইন্সুরেন্স কর্পোরেশনস রুলস, ১৯৭৭ এবং বাংলাদেশে প্রযোজ্য সংশ্লিষ্ট অপরাপর আইনের আওতায় বাংলাদেশে জীবন বীমা ব্যবসায়ে নিয়োজিত।

১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে মোট ৮১টি  বীমা কোম্পানি রেজিস্ট্রিকৃত হয়। এদের মধ্যে ৪০টি ছিল দেশিয় উদ্যোক্তাদের দ্বারা পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ও নিবন্ধিত কোম্পানি। অবশিষ্ট ৪১টি ছিল বিদেশি কোম্পানি। স্থানীয় মালিকানাধীন ৪০টি কোম্পানির মধ্যে ১০টি পূর্ব পাকিস্তানে এবং ৩০টি পশ্চিম পাকিস্তানে নিবন্ধিত হয়েছিল। ৪১টি বিদেশি বীমা কোম্পানির মধ্যে ২১টি ব্রিটেন, ৮টি ভারত, ৫টি আমেরিকা, ৩টি নিউজিল্যান্ড, ১টি অস্ট্রেলিয়া, ১টি কানাডা, ১টি ফ্রান্স এবং ১টি ছিল হংকং-এ নিবন্ধিত। ৪০টি পাকিস্তানি বীমা কোম্পানির মধ্যে ১০টি শুধু জীবন বীমা, ২১টি জীবন ও সাধারণ বীমা এবং ৯টি বিবিধ বীমা ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিল। পক্ষান্তরে, বিদেশি কোম্পানিগুলি জীবন বীমা ব্যতীত অন্যান্য বীমা ব্যবসায়ে অধিকতর মনোযোগী ছিল। তাদের মধ্যে মাত্র ২টি কোম্পানি একক ব্যবসায় হিসেবে জীবন বীমা ব্যবসায় পরিচালনা করত, ১টি কোম্পানি জীবন ও সাধারণ উভয় বীমাসেবা প্রদান করত।

স্থানীয়ভাবে নিবন্ধিত ১০টি কোম্পানিসহ স্বাধীনতা পূববর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৭৫টি বীমা কোম্পানি ব্যবসারত ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স (জাতীয়করণ) আদেশ ১৯৭২-এর মাধ্যমে দেশের গোটা বীমা ব্যবসায়কে রাষ্ট্রীয়করণ করে। অধিগৃহীত বীমা কোম্পানিগুলির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ৫টি বিভিন্ন বীমা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে। নবপ্রতিষ্ঠিত এ বীমা কর্পোরেশনগুলি ছিল বাংলাদেশ জাতীয় বীমা কর্পোরেশন, কর্ণফুলি বীমা কর্পোরেশন, তিস্তা বীমা কর্পোরেশন, সুরমা জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশন। ১৯৭৩ সালে সরকার দেশের জীবন বীমা ও সাধারণ বীমাকে সমন্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুরমা জীবন বীমা কর্পোরেশন ও রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশনকে একত্রিত করে জীবন বীমা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। অপরদিকে কর্ণফুলি বীমা কর্পোরেশন ও তিস্তা বীমা কর্পোরেশনকে একত্রিত করে প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। ১৯৭৩ সালেই সরকার পরবর্তী একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয় বীমা কর্পোরেশনকে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন-এর সাথে একত্রিত করে এটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

১৯৮৫ সাল পর্যন্ত জীবন বীমা কর্পোরেশন বাংলাদেশে এককভাবে জীবন বীমা ব্যবসায় পরিচালনা করত। ফলে কর্পোরেশনকে কোনো প্রকার প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয় নি। ইন্সুরেন্স (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এবং ইন্সুরেন্স কর্পোরেশনস (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর মাধ্যমে সরকার দেশে বেসরকারি খাতে বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও ব্যবসায় পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেয়। ফলে ১৯৮৫ সাল থেকে এ দেশে বেসরকারি খাতে বীমা ব্যবসায়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ৩১ ডিসেম্বর ২০০০ পর্যন্ত দেশে বেসরকারি উদ্যোগে কমপক্ষে ১৭টি জীবন বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। জীবন বীমা কর্পোরেশন-এর একচ্ছত্র ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতাও সৃষ্টি হয়।

জীবন বীমা কর্পোরেশন ১৫টি বিভিন্ন ধরনের জীবন বীমা স্কিমের মাধ্যমে বীমাসেবা বিক্রয় করছে। এ স্কিমগুলি হচ্ছে আমৃত্যু জীবন বীমা, পলিসির মূল্য পরিশোধ ভিত্তিতে বীমা, শিশু প্রতিরক্ষা বীমা, শিশুদের পলিসির মূল্য পরিশোধভিত্তিক বীমা, পলিসির অনুমিত মূল্য পরিশোধভিত্তিক বীমা, পেনশন স্কিম বীমা, এক দফায় প্রিমিয়াম পরিশোধভিত্তিক বীমা, বন্ধক প্রতিরক্ষা বীমা, মেয়াদি গোষ্ঠী বীমা, পলিসির মূল পরিশোধভিত্তিক গোষ্ঠী বীমা, পরিবর্তনশীল হিসাবে পলিসির মূল্য পরিশোধভিত্তিক গোষ্ঠী বীমা, দলগত পেনশন বীমা, গ্রামীণ বীমা, যুগ্ম জীবন বীমা এবং বর্ধিষ্ণু হারে প্রিমিয়াম পরিশোধভিত্তিক বীমা।

১৯৯৮ সালে জীবন বীমা কর্পোরেশন মোট ১,৪০২.৮০ মিলিয়ন টাকা প্রিমিয়াম আয় সংগ্রহ করে এবং এর মধ্যে ৪০১.২০ মিলিয়ন টাকা নতুন বীমা, ৯১৩ মিলিয়ন টাকা নবায়নকৃত বীমা এবং ৮৮.৬০ মিলিয়ন টাকা ছিল গোষ্ঠী বীমা থেকে। অপরদিকে, একই বছর কর্পোরেশন বিভিন্ন জীবন বীমা স্কিমের বিপরীতে মোট ৬২৯.২০ মিলিয়ন টাকার বীমাদাবি পরিশোধ করেছে। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ তারিখে কর্পোরেশন-এর অর্জিত কার্যচালনা মুনাফার পরিমাণ ছিল ২৭৯.৯০ মিলিয়ন টাকা। জীবন বীমা ব্যবসায় ব্যতীত কর্পোরেশন ১৯৯৮ সালে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ থেকে ১৮৯.২০ মিলিয়ন টাকা নীট আয় লাভ করে।

১৯৯৮ সালে এ কর্পোরেশন ৬৫,০৮৬টি নতুন ব্যক্তি জীবন বীমা পলিসি বিক্রয় করে এবং এ পলিসিগুলির অধীনে বীমাকৃত টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ৫,৭২৩ মিলিয়ন টাকা। উল্লিখিত পলিসিসমূহের মধ্যে ১০,২৪৪টি ছিল মহিলা জীবন বীমা পলিসি এবং ৪৪,২০৯টি পল্লী জীবন বীমা পলিসি। মহিলা জীবন বীমা ও পল্লী জীবন বীমা পলিসিসমূহের বিপরীতে বীমাকৃত টাকার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭০০ মিলিয়ন ও ৩,১৯১.৪০ মিলিয়ন। পল্লী বীমা পলিসিসমূহ কর্পোরেশনের ‘নন-মেডিক্যাল বিজনেস স্কিম’-এর আওতায় পল্লী এলাকায় বিক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত বছরে কর্পোরেশন তাঁর চিকিৎসা বহির্ভূত ব্যবসায় স্কিম-এর অধীনে ৩,৮২৪.৪০ মিলিয়ন টাকা বীমাকৃত অঙ্কের বিপরীতে ৪৭,৯২৫টি বীমা পলিসি ইস্যু করেছে। গোষ্ঠী বীমা স্কিম-এর আওতায় কর্পোরেশন এ যাবৎ ৩৪০টি সংগঠন/প্রতিষ্ঠানের ৭,০৭,৯০০ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর বীমা ঝুঁকি গ্রহণ করে এবং এর বিপরীতে বীমাকৃত অঙ্কের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৭৫৭৫.৬ মিলিয়ন টাকা। গোষ্ঠী বীমা স্কিম থেকে কর্পোরেশন ১৯৯৮ সালে ৮৮.৬০ মিলিয়ন টাকা প্রিমিয়াম লাভ করে।

কর্পোরেশন কর্তৃক ২০০০ সাল পর্যন্ত বিক্রিত ব্যক্তি জীবনবীমা পলিসিসমূহের মধ্যে ৩,১৫,৭৩৫টি ছিল নিয়মিত এবং এগুলির বিপরীত বীমাকৃত টাকার পরিমাণ ছিল ২৩,৭৪২ মিলিয়ন টাকা। এসব পলিসির মধ্যে ৩,১০,৫৫৫টি (বীমার অঙ্ক ২৩,৭২৭.৪০ মিলিয়ন টাকা) কর্পোরেশন নিজে ইস্যু করে নিজেই সেগুলির ঝুঁকি অবলিখন করে। অবশিষ্ট ১৪.৬০ মিলিয়ন টাকা বীমার অঙ্ক (৫,১৮০টি পলিসির) ঝুঁকি কর্পোরেশন-এর পুরাতন ইউনিট তথা সুরমা ও রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশন কর্তৃক ইস্যু করা হয়েছিল। একই বছরে ৩,০৪৭ মিলিয়ন টাকা বীমার অঙ্কসহ মোট ৪৩,৬৪১টি ব্যক্তি জীবনবীমা পলিসি স্থগিত/অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

সুইজারল্যান্ডের সুইস রি-ইন্সুরেন্স গ্রুপ এবং জার্মানির মিউনিখ রি-ইন্সুরেন্স কোম্পানির সাথে জীবন বীমা কর্পোরেশনের পুনর্বীমা চুক্তি আছে এবং এ দুটি কোম্পানির সাথে কর্পোরেশন তার গৃহীত বীমা ঝুঁকি পুনর্বীমা করে। তবে কর্পোরেশন অবলিখিত ঝুঁকির অঙ্কের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ মিলিয়ন টাকা পুনর্বীমা না করে নিজে ধারণ করতে পারে। জীবন বীমা কর্পোরেশন দেশের বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত জীবন বীমা কোম্পানিগুলির মধ্যে ২টি কোম্পানির বীমা ঝুঁকি পুনর্বীমা করার মাধ্যমে পুনর্বীমাকারী হিসেবেও কাজ করছে।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ তারিখে জীবন বীমা কর্পোরেশন-এর মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩,৩২৮.৬০ মিলিয়ন টাকা এবং বিনিয়োগ-পত্রকোষের আইটেমসমূহ ছিল সরকারি সিকিউরিটিজ, বন্ধকী সম্পদের ওপর প্রদত্ত ঋণ, পলিসিসমূহের বিপরীতে প্রদত্ত ঋণ, অগ্রিম সেতু অর্থায়ন, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ও ডিবেঞ্চার ক্রয়, বিভিন্ন ব্যাংকে রক্ষিত স্থায়ী আমানত ইত্যাদি। ওই  তারিখে কর্পোরেশন-এর মোট পরিসম্পদের পরিমাণ ছিল ৪,৩৪০.৪৯ মিলিয়ন টাকা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মনোনীত ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালক পর্ষদ কর্পোরেশন-এর সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকিসহ এর ব্যবসায়িক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য নীতিমালা অনুমোদন করে। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্পোরেশনটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২ জন মহাব্যবস্থাপক, ৬ জন উপ মহাব্যবস্থাপক এবং ২ জন সহকারী মহাব্যবস্থাপক কর্পোরেশনটির ব্যবস্থাপনায় প্রধান নির্বাহীকে সহায়তা প্রদান করে। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ তারিখে এর মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১,৭৭২ জন। ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ের ৮টি বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে জীবন বীমা কর্পোরেশন ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কার্যাবলী সম্পাদন করে। প্রধান কার্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত একটিসহ সারাদেশে এ কর্পোরেশনের মোট ১৯টি বিভাগীয়/আঞ্চলিক অফিস রয়েছে।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ তারিখে জীবন বীমা কর্পোরেশনের সক্রিয় বীমা এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০,৭৪৭টি। তবে কর্পোরেশনের নিয়োগকৃত কোনো অ্যাকচ্যুয়ারি নেই। পাকিস্তান ভিত্তিক একজন অ্যাকচ্যুয়ারি বর্তমানে কর্পোরেশনের দায়-সম্পদ, আয়-ব্যয় ইত্যাদির অ্যাকচ্যুয়ারি মূল্যায়ন করেন। এ কর্পোরেশনের একটি নিজস্ব দাবি পর্যালোচনা কমিটি রয়েছে। উক্ত কমিটি বীমা দাবিকারীদের অনুরোধে বাতিলকৃত বীমাদাবিসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক সেগুলির নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশনা প্রদানে সুপারিশ রাখে। প্রধান কার্যালয়ের টেকনিক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ পর্যালোচনা কমিটির কার্যাবলী তদারক করে। [এস.এম মাহফুজুর রহমান]