জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া

জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া  সম্ভবত ১৮৩৬ সাল থেকে এর শুরু। এ বছর নৌপরিবহণ ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ভারতীয় কয়লা ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কয়লা সংক্রান্ত একটি কমিটি (Coal Committee) গঠন করে। ‘গ্রেট ট্রিগনোমিট্রিক্যাল সার্ভের’ শল্যচিকিৎসক ড. হেনরি ওয়েস্টলি ভয়সিকে ভারতীয় ভূতত্ত্ববিদ্যার জনক বলে গণ্য করা যেতে পারে। ১৮৩৭ ও ১৮৪৫ সালে কমিটির সচিব স্যার জন ম্যাকক্লিল্যান্ড প্রথমবারের মতো ট্রেনিংপ্রাপ্ত ভূতাত্ত্বিকদের নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন। স্যার ম্যাকক্লিল্যান্ডের ১৮৪৮-৪৯ সময়কালের প্রথম রিপোর্টে ‘জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ শব্দগুচ্ছ প্রথমবারের মতো ব্যবহূত হয়। ১৮৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি স্যার ডেভিড হিরাও উইলিয়মস জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ভূতাত্ত্বিক জরিপকারী হিসেবে নিয়োজিত হন। ১৮৪৮ সালে স্যার উইলিয়মের মৃত্যুর পর ম্যাকক্লিল্যান্ড স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন এবং ১৮৫০ সালের ১ এপ্রিল তাঁর অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত ‘অফিসিয়েটিং সার্ভেয়র’ হিসেবে ভূতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৫১ সালের ৫ মার্চ তারিখে স্যার টমাস ওল্ডহ্যাম ভূতাত্ত্বিক জরিপকারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তখন থেকে অনেক নতুন খনিক্ষেত্র আবিষ্কারে ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানে বিরাট সাফল্য-অর্জনে ‘জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার’ উজ্জ্বল কৃতিত্বের অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস চলতে থাকে।

বাংলার গভর্নরের নিকট পেশকৃত তাঁর স্মারকলিপিতে (১৮৫২) স্যার টমাস ওল্ডহ্যাম ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র তৈরি ও খনিজ পদার্থসমূহ আবিষ্কার নথিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র কার্যাবলীকে ভূতাত্ত্বিক গবেষণার আওতায় নিয়ে আসার ধারণা বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেন। ১৮৪৮ সালে যে বড় ধরনের কর্মভারের সূচনা করা হয় তাতে ১৯০৫ সালে শুধুমাত্র ১৬ জন ভূতত্ত্ববিদ ও দুজন খনিজ বিশেষজ্ঞ ভূতাত্ত্বিক ছিলেন এবং ১৯৩৯ সালে ভারত থেকে ১৭ জন ভূতত্ত্ববিদকে অধিষ্ঠিত করার ফলে তাঁদের সর্বমোট সংখ্যা ২৫-এ উন্নীত হয়। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ভারতীয় ভূতত্ত্ববিদদের পথ প্রদর্শনকারীদের মধ্যে রাম সিংহ্ (১৮৭৩), কিষেণ সিংহ (১৮৭৪), হীরালাল (১৮৭৪), পি.এন বসু (১৮৮০), পি.এন দত্ত (১৮৮৭-১৮৯৪) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রথম নথি ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। শুরুতে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তাদের নিজস্ব কোনো প্রকাশনার ব্যবস্থা ছিল না এবং তাঁদের গবেষণাপত্রসমূহ এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর জার্নাল ও মাদ্রাজ জার্নাল অব লিটারেচার অ্যান্ড সাইন্স-এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো।

প্রাথমিক প্রচেষ্টা নিবদ্ধ ছিল কয়লা আবিষ্কারের উপর। বাংলার কয়লাখনিতে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করা হয়। পশ্চিম বর্ধমান, মানভূম ও বীরভূমের ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র ১৮৪৭ সালের গোড়ার দিকে তৈরি করা হয়। জরিপ কাজ পরিচালনার পর ডব্লিউ,টি ব্ল্যানফোর্ড রাণীগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রের প্রথম ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র সরকারিভাবে প্রকাশ করেন। কয়লা ধারণকারী হিসেবে প্রকল্পিত ভূখন্ডসমূহ এবং উত্তর বাংলার দার্জিলিং জেলায় তামার উপস্থিতির মতো আকস্মিক ঘটনা ম্যালেটের দৃষ্টিগোচর হয়।

শিলা ও খনিজ পদার্থের উপর গবেষণা চালাতে মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার প্রবর্তিত হয় ১৮৯০ সালে। জব চার্নকের কবরের উপর স্থাপিত স্মৃতিপ্রস্তর বিশ্লেষণ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক স্যার টমাস হল্যান্ড তাঁর ১৯০০ সালের স্মৃতিকথায় হাইপারস্থিন বহনকারী গ্রানাইটিক শিলার বর্ণনা দেন এবং চার্নোকাইট শিলা আবিষ্কার করেন।

স্থানীয় লৌহ-আকরিক থেকে পরীক্ষামূলকভাবে লৌহ আহরণের জন্য রানীগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রই যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল স্থান মেডলিকটের এরূপ মন্তব্যের পর বঙ্গীয় লৌহ কোম্পানি গঠিত হয় এবং ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত ১২,৭০০ টন অঢালাইকৃত লৌহ উৎপাদন করা হয়। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের অধীনে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণীতে ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে সংঘটিত কাছাড় ভূমিকম্পের উপর পরিচালিত গবেষণার উদ্ধৃতিসমূহ প্রকাশিত হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন তারিখে আরেকটি ভূমিকম্প হয় যার উৎপত্তিস্থল ছিল আসাম এবং এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলা প্রদেশের বিশাল এলাকা প্রভাবান্বিত করে। রানীগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেললাইন সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রকৌশল কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ণের জন্য প্রথম ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ স্যার টমাস হল্যান্ড ১৮৫৯ সালে হাতে নেন এবং ১৮৫৩ সালে প্রথম রেললাইন উদ্বোধন করা হয়।

১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ব্যাপী বাংলায় প্রধান ভূতাত্ত্বিক কার্যাবলীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ঝরিয়া ও রানীগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রসমূহের বিস্তারিত জরিপের জন্য প্যাসকো কর্তৃক প্রতি মাইল সমান চার ইঞ্চি স্কেলে একটি মানচিত্র তৈরি করা। প্রারম্ভে রানীগঞ্জ থেকে কয়লা ধারণকারী হিসেবে প্রকল্পিত ভূখন্ডসমূহের অভ্যন্তরে লৌহশিলা স্ফীতি সহযোগে প্রাপ্ত লৌহকে আকরিক থেকে পৃথক করার জন্য ধাতু গলানোর আধুনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বাঁকুড়া জেলার সুবিদিত টাংস্টেন নামক দুষ্প্রাপ্য ধাতুর আকরিককে খুঁড়ে তোলার কাজ হাতে নেয়া হয়।

ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কলকাতাস্থ ভারতীয় জাদুঘরের ভূতাত্ত্বিক শাখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ১৮৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ভূতত্ত্বের জাদুঘরটি শুরুতে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের দালানে অবস্থান করছিল। জাদুঘরটি ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় এবং ১৮৫৬ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে জনসাধারণের দর্শনার্থে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকে ভারতীয় জাদুঘরটি দেশ ও বিদেশ উভয় স্থান থেকে প্রাপ্ত শিলা, খনিজদ্রব্য ও জীবাশ্মসমূহের গুরুত্বপূর্ণ নমুনা রাখার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। উল্কাপিন্ডসমূহের সংগ্রহ (১৮৬৭ সালে এগুলির সংখ্যা ছিল ২৪৭) বিশ্বের অন্যতম সেরা ও এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এখনও পর্যন্ত ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ভূতাত্ত্বিক নমুনাসমূহের জিম্মাদার।  [এস চক্রবর্তী]