জাহানাবাদ সমাধিসৌধ
জাহানাবাদ সমাধিসৌধ রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার জাহানাবাদ গ্রামে অবস্থিত। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩২ কিমি দূরে রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ সড়কের ডানদিকে সমাধিসৌধটি অবস্থিত। ইমারতটি এখন ভগ্ন দশায় রয়েছে। বর্তমানে বাইরের দিকের আচ্ছাদন অধিকাংশই খসে পড়েছে। এটির তিনটি কোণই ভেঙ্গে পড়েছে। গম্বুজটিতেও ভাঙন ধরেছে এবং এর উপর ছোট ছোট বটগাছ জন্মেছে। সমাধিটির প্রবেশ পথ এক দিকে হেলে পড়েছে।
ইট দিয়ে নির্মিত বর্গাকার সমাধিসৌধটির প্রতিবাহুর দৈর্ঘ্য বাইরের দিক থেকে ৬ মিটার এবং ভেতরের দিক থেকে ৪ মিটার। স্কুইঞ্চের উপর নির্মিত একটি গম্বুজ দ্বারা সমাধিটি আচ্ছাদিত। বাইরের দিক থেকে গম্বুজটি একটি অষ্টভুজাকৃতির পিপার উপর স্থাপিত। স্কুইঞ্চ এর উত্তর-পূর্ব কোণে সম্ভবত মোমবাতি রাখার জন্য দুটি ছোট কুলুঙ্গি ছিল। অভ্যন্তরের সমাধি ফলকটি ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালেও সুরক্ষিত ছিল। তবে এখন এটি মেঝের সাথে মিশে গেছে। সমাধিটির চারটি প্রধান দিকে ৪টি প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশ পথগুলির প্রতিটিতেই রয়েছে দুটি করে পাথরের তৈরি চৌকাঠ, একটি পাথরের সর্দল এবং একটি করে প্রস্তর ফলক। প্রতিটি প্রবেশপথ ০.৮০ মি প্রশস্ত এবং ১.৫০ মি উঁচু। প্রবেশপথ গুলিতে ৪টি চতুর্কেন্দ্রিক খিলান ব্যবহূত হয়েছে। কেবল দক্ষিণদিকের খিলানটি সম্ভবত সূচাঁলো। এ খিলানের গায়ে একটি শিলালিপি ছিল। বর্তমানে এটি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরএ সংরক্ষিত আছে।
এক সময়ে সমাধিটি পলেস্তরায় আচ্ছাদিত ছিল, যার চিহ্ন এখনও এখানে সেখানে দেখা যায়। দক্ষিণের প্রবেশপথের বামদিকে এর খিলানের চূড়ার সমান্তরালে একটি কালো কষ্টি পাথরের ফলক লাগানো ছিল। এটি সম্ভবত নিকটবর্তী কোনো পুরাতন ইমারতের অংশবিশেষ। এ পাথর ফলকের মাঝের অংশে খোদিত রয়েছে একটি বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলানের চূড়ার নকশা। এ খিলানের স্প্যানড্রেল দুটি গোলাপ নকশা দ্বারা অলংকৃত। এক সময়ে দেওয়ালের উপরের অংশ এবং গম্বুজের পিপা পদ্ম পাপড়ি নকশা দিয়ে অলংকৃত ছিল। বর্তমানে এগুলি প্রায় মুছে গেছে। গম্বুজের উপরে ছিল পলেস্তরা দিয়ে নির্মিত বড় একটি গোলাপ নকশা। সেটিও বর্তমানে ভেঙ্গে পড়েছে।
সমাধিটির দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের উচ্চতা ৪.২৫ মি এবং প্রস্থ ১.১৫ মি। এ প্রবেশ দ্বারের খিলানটি বর্তমানে অনেকাংশেই ভেঙ্গে গেছে। এক সময়ে পাশের দেওয়ালের সামনের অংশে একটির উপর আর একটি সজ্জিত জোড়া কুলুঙ্গির অলংকরণ ছিল।
একসময়ে সমাধিটির দক্ষিণে একটি এবং পূর্বদিকে একটি পুকুর ছিল। কিন্তু বর্তমানে এগুলি প্রায় শুকিয়ে গেছে এবং কিছু অংশ এখন কৃষি কাজে ব্যবহূত হচ্ছে।
সমাধিসৌধটির নির্মাতা কে বা কার জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা জানা যায় নি। কাপড়ের চাঁদোয়া ঝুলানোর জন্য স্কুইঞ্চের কেন্দ্রে লোহার রিং স্থাপন করা ছিল। দেখে মনে হয়, সমাধিটি কোনো সুফি সাধকের এবং তিনি সম্ভবত শাহ সুলতানের একজন অনুসারী অথবা সহযোগী ছিলেন। শাহ সুলতানের সমাধিটির নিকটেই এটি অবস্থিত। বলা হয় যে, মুগল সুবাহদার শায়েস্তা খান এ সুফি সাধকের স্মৃতি রক্ষার্থে সুলতানগঞ্জ শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাই যদি এ সমাধিতে শায়িত সুফি সাধক শাহ সুলতানের অনুসারী কিংবা সহযোগী হন তাহলে তিনিও সম্ভবত এ এলাকায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন একই সময়ে অথবা তার কিছুকাল পরে- অর্থাৎ সতেরো শতকের শেষ বা আঠারো শতকের গোড়ার দিকে। এ সমাধি থেকে যে শিলালিপিটি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর এ সংরক্ষিত হয়েছে সেটিতে ৮৮৯ হিজরিতে (১৪৭৪ খ্রি) একটি মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। এটির সঙ্গে ইমারতটির হয়ত কোনো সম্পর্ক নেই। সম্ভবত এ সমাধি নির্মাণের সময়ে অন্য কোনো স্থান থেকে শিলালিপিটি সংগ্রহ করে অলংকরণ হিসেবে দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের উপরে স্থাপন করা হয়েছিল। শিলালিপিতে উৎকীর্ণ মহানবী (স.)-এর বাণীর ধর্মীয় গুরুত্বও সম্ভবত কয়েক শতক পরে নির্মিত এ সমাধির গায়ে শিলালিপিটি স্থাপনের পক্ষে যুক্তি হয়ে উঠেছিল। [সুলতান আহমেদ]