জাহাঙ্গীর, বোরহানউদ্দিন খান
জাহাঙ্গীর, বোরহানউদ্দিন খান (১৯৩৬-২০২০) বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানী, লেখক, প্রবন্ধকার, কবি, সাহিত্যিক, চিত্র সমালোচক ও ভাষা সৈনিক। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (বিদ্যোৎ সমাজে বি.কে জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত) ১৯৬৬ সালের ৯ই জানুয়ারি ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) জেলার তৎকালীন চাঁদপুর মহাকুমার (বর্তমানে জেলা) গুলবাহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আশেক আলী খান এবং মাতা সুলতানা বেগম। ১৯৫০ সালে ঢাকার সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে মেট্রিক্যুলেশন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। অতঃপর ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বি.এ (অনার্স) এবং ১৯৫৬ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন। অবশেষে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি লন্ডন যান এবং ১৯৭৪ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল, 'Differentiation, Polarisation and Confrontation in Rural Bangladesh’.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু। এরপর তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। এ বিভাগ থেকে প্রফেসর হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯২-১৯৯৫ সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য ছিলেন।
তাঁর লেখা একাধিক গ্রন্থ মনোগ্রাফ ও প্রবন্ধ দেশে-বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত তিনি সমাজ নিরিক্ষণ (বাংলা ভাষায়) এবং The Journal of Social Studies নামে দু’টি জার্নাল সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। তাঁর গবেষণা ও সৃজনশীল কর্মের মধ্যে Rural Society, Power Structure and Class Practice (1972), Contemporary Painters: Bangladesh (1974), Differentiation, Polarisation and Confrontation in Rural Bangladesh (1979), Problematics of Nationalism in Bangladesh (1986), Violence and Consent in a Peasant Economy and Other Essays (1990), The Quest of Zainul Abedin (2000), স্বদেশ ও সাহিত্য (১৯৬৯), বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ এবং মৌলবাদ (১৯৯৬), আধুনিকতা এবং উত্তর আধুনিকতার অভিজ্ঞতা (১৯৯৬) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বাইরে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল। তিনি ছিলেন কবিতা প্রেমিক এবং নিজেও কবিতা নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ৫২-র মহান ভাষা শহীদের ওপর একুশে ফেব্রুয়ারি শিরোনামে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থে তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে থেকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করনে নিজ জীবনের সর্বপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে ‘স্বাধীনতা’ নামে একটি সাময়িকী বের করতেন। সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার এবং ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পুরষ্কার’ সহ বিভিন্ন পুরষ্কার ভূষিত হন। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর নাম নুজহাত জাহাঙ্গীর।
২০২০ সালের ২৩ শে মার্চ ৮৪ বছর বয়সে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীররের জীবনের অবসন ঘটে। তাঁকে গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্ত্রীও আর বেঁচে নেই। জাহাঙ্গীর দম্পতির একটি মাত্র পুত্র সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]