জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(fix: image tag)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ'''  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত। স্থাপনা দুটি বাংলায় বিদ্যমান মুসলিম নিদর্শনসমূহের মধ্যে সর্বপ্রাচীন বলে বিবেচিত। একটি [[শিলালিপি|শিলালিপি]] অনুযায়ী মসজিদটি ৬৯৭ হিজরি/১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছে। ত্রিবেণী (তিনটি নদীর সঙ্গমস্থল যথা গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এবং এ থেকেই এ নামকরণ) হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট একটি প্রাচীন তীর্থস্থান। মুসলমানগণ তাদের বাংলা বিজয়ের প্রথম দিকে এটি দখল করে।  
'''জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ'''  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত। স্থাপনা দুটি বাংলায় বিদ্যমান মুসলিম নিদর্শনসমূহের মধ্যে সর্বপ্রাচীন বলে বিবেচিত। একটি [[শিলালিপি|শিলালিপি]] অনুযায়ী মসজিদটি ৬৯৭ হিজরি/১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছে। ত্রিবেণী (তিনটি নদীর সঙ্গমস্থল যথা গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এবং এ থেকেই এ নামকরণ) হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট একটি প্রাচীন তীর্থস্থান। মুসলমানগণ তাদের বাংলা বিজয়ের প্রথম দিকে এটি দখল করে।  


[[Image:ZafarKhanGhaziMosquePlan.jpg|thumb|400px|ভূমি নকশা, জাফর খান গাজী মসজিদ]]
আয়তাকার মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ২৩.৩৮মি × ১০.৫৩ মি। চুনসুরকির গাঁথনিবিহীন আয়তাকারে কর্তিত পাথর একটির উপর অন্যটির স্থাপনের ঐতিহ্যগত হিন্দুরীতির পরিবর্তে মুসলমানদের প্রবর্তিত ‘ইট ও পাথর’ রীতির এটাই সর্বপ্রাচীন বিদ্যমান নিদর্শন। মসজিদে ব্যবহূত পাথরগুলি হিন্দু মন্দিরের উপকরণ ছিল। কয়েকটি পাথরে খোদাই করা হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এটি প্রমাণ করে। বহুবার সংস্কারের ফলে এ মসজিদের আসল অবয়ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আয়তাকার মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ২৩.৩৮মি × ১০.৫৩ মি। চুনসুরকির গাঁথনিবিহীন আয়তাকারে কর্তিত পাথর একটির উপর অন্যটির স্থাপনের ঐতিহ্যগত হিন্দুরীতির পরিবর্তে মুসলমানদের প্রবর্তিত ‘ইট ও পাথর’ রীতির এটাই সর্বপ্রাচীন বিদ্যমান নিদর্শন। মসজিদে ব্যবহূত পাথরগুলি হিন্দু মন্দিরের উপকরণ ছিল। কয়েকটি পাথরে খোদাই করা হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এটি প্রমাণ করে। বহুবার সংস্কারের ফলে এ মসজিদের আসল অবয়ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


পূর্বদেয়ালে খিলান পদ্ধতিতে তৈরি পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। খিলানগুলি মোটা ও ছোট আকারের ষষ্ঠভুজাকৃতির প্রস্তরস্তম্ভের উপর স্থাপিত। মসজিদটি বাংলায় মুসলিমদের দ্বারা বিকশিত বহুগম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মিত মসজিদের অনুরূপ। এর ছাদের গম্বুজের সংখ্যা, পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথের সংখ্যার সঙ্গে অন্য একপাশের প্রবেশপথের সংখ্যার গুণফলের সমান। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে প্রবেশপথ আছে। ফলে মসজিদটির ছাদে দশটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা দুটি লম্বালম্বি পথ (আইল) এবং পাঁচটি ছোট ‘বে’তে বিভক্ত। ফলে দশটি পৃথক খোপ সৃষ্টি হয়েছে। কোণাসমূহে ইটনির্মিত পেন্ডেন্টিভ দ্বারা প্রস্তরস্তম্ভ ও সূঁচালো খিলানের উপর গম্বুজগুলি স্থাপিত।  
পূর্বদেয়ালে খিলান পদ্ধতিতে তৈরি পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। খিলানগুলি মোটা ও ছোট আকারের ষষ্ঠভুজাকৃতির প্রস্তরস্তম্ভের উপর স্থাপিত। মসজিদটি বাংলায় মুসলিমদের দ্বারা বিকশিত বহুগম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মিত মসজিদের অনুরূপ। এর ছাদের গম্বুজের সংখ্যা, পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথের সংখ্যার সঙ্গে অন্য একপাশের প্রবেশপথের সংখ্যার গুণফলের সমান। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে প্রবেশপথ আছে। ফলে মসজিদটির ছাদে দশটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা দুটি লম্বালম্বি পথ (আইল) এবং পাঁচটি ছোট ‘বে’তে বিভক্ত। ফলে দশটি পৃথক খোপ সৃষ্টি হয়েছে। কোণাসমূহে ইটনির্মিত পেন্ডেন্টিভ দ্বারা প্রস্তরস্তম্ভ ও সূঁচালো খিলানের উপর গম্বুজগুলি স্থাপিত।  
[[Image:জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ_html_88407781.png]]
[[Image:ZafarKhanGhaziMosquePlan.jpg|thumb|400px]]
ভূমি নকশা, জাফর খান গাজী মসজিদ


সারিবদ্ধ সূঁচালো খিলানে কালো রঙের নকশা মসজিদটির অভ্যন্তরভাগকে প্রশস্ত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে বহুখাঁজ খিলানের মধ্যে পাঁচটি মিহরাব আছে। মিহরাব দেয়ালে প্যানেলের অভ্যন্তরে স্বল্পপরিমাণে নকশা করা হয়েছে। মসজিদের কার্নিস ও প্যারাপেট বাঁকানো নয়। উন্মুক্ত অঙ্গন, রিওয়াক ও মিনারবিহীন শুধু প্রার্থনাকক্ষ সম্বলিত বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী মসজিদ নির্মাণরীতি এ মসজিদে অনুসৃত হয়েছে। এ মসজিদের অভ্যন্তরের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এ যে, এর মাঝবরাবর উত্তর-দক্ষিণের ‘বে’তে একটি দেয়াল খিলানের উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত উঠে গেছে। মসজিদের এ অংশগুলিতেই পোড়ামাটির ফলকের অলঙ্করণ লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণের দেয়ালটি ভালভাবে সংরক্ষিত আছে যা প্যানেলে বিন্যস্ত। মাঝের প্যানেলটিকে গোলাপের নকশাকৃত বর্গাকার ফ্রেম দ্বারা উল্লম্বভাবে দুটি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এর নিচের অংশটি বর্ণাঢ্য পত্ররাজির সঙ্গে প্যাঁচানো আঙ্গুরলতার নকশায় চিত্রিত এবং উপরের অংশটি ঘনপত্ররাজি ও গুল্মের মধ্যে চূড়াসহ দুটি অর্ধখিলান মোটিফে নকশাকৃত। পার্শ্ববর্তী প্যানেলগুলিও একইভাবে অলঙ্কৃত। সব প্যানেলই চূড়াসহ বহুখাঁজ খিলানে নকশাকৃত।  
সারিবদ্ধ সূঁচালো খিলানে কালো রঙের নকশা মসজিদটির অভ্যন্তরভাগকে প্রশস্ত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে বহুখাঁজ খিলানের মধ্যে পাঁচটি মিহরাব আছে। মিহরাব দেয়ালে প্যানেলের অভ্যন্তরে স্বল্পপরিমাণে নকশা করা হয়েছে। মসজিদের কার্নিস ও প্যারাপেট বাঁকানো নয়। উন্মুক্ত অঙ্গন, রিওয়াক ও মিনারবিহীন শুধু প্রার্থনাকক্ষ সম্বলিত বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী মসজিদ নির্মাণরীতি এ মসজিদে অনুসৃত হয়েছে। এ মসজিদের অভ্যন্তরের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এ যে, এর মাঝবরাবর উত্তর-দক্ষিণের ‘বে’তে একটি দেয়াল খিলানের উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত উঠে গেছে। মসজিদের এ অংশগুলিতেই পোড়ামাটির ফলকের অলঙ্করণ লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণের দেয়ালটি ভালভাবে সংরক্ষিত আছে যা প্যানেলে বিন্যস্ত। মাঝের প্যানেলটিকে গোলাপের নকশাকৃত বর্গাকার ফ্রেম দ্বারা উল্লম্বভাবে দুটি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এর নিচের অংশটি বর্ণাঢ্য পত্ররাজির সঙ্গে প্যাঁচানো আঙ্গুরলতার নকশায় চিত্রিত এবং উপরের অংশটি ঘনপত্ররাজি ও গুল্মের মধ্যে চূড়াসহ দুটি অর্ধখিলান মোটিফে নকশাকৃত। পার্শ্ববর্তী প্যানেলগুলিও একইভাবে অলঙ্কৃত। সব প্যানেলই চূড়াসহ বহুখাঁজ খিলানে নকশাকৃত।  
১৬ নং লাইন: ১১ নং লাইন:
উত্তর ‘বে’-এর অলঙ্করণ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে যেটুকু বিদ্যমান আছে তাতে দক্ষিণ অংশের সাথে পার্থক্য প্রতীয়মান। এ অংশে উল্লম্বভাবে স্থাপিত ছোট দুটি প্যানেল দেখা যায়, যার প্রতিটি চূড়াসহ বহুখাঁজ খিলানে নকশাকৃত এবং চূড়া থেকে একটি শিকল ঝুলন্ত অবস্থায় চিত্রিত যার শেষভাগে গোলাকার ঘণ্টা আছে। এ ‘বে’গুলির উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এগুলি মসজিদের অভ্যন্তর ভাগের নকশার সাথে সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু রাজশাহী জেলার [[বাঘা মসজিদ|বাঘা মসজিদ]] এর (১৫২৪) সাথে এর চমৎকার মিল দেখা যায়।  
উত্তর ‘বে’-এর অলঙ্করণ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে যেটুকু বিদ্যমান আছে তাতে দক্ষিণ অংশের সাথে পার্থক্য প্রতীয়মান। এ অংশে উল্লম্বভাবে স্থাপিত ছোট দুটি প্যানেল দেখা যায়, যার প্রতিটি চূড়াসহ বহুখাঁজ খিলানে নকশাকৃত এবং চূড়া থেকে একটি শিকল ঝুলন্ত অবস্থায় চিত্রিত যার শেষভাগে গোলাকার ঘণ্টা আছে। এ ‘বে’গুলির উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এগুলি মসজিদের অভ্যন্তর ভাগের নকশার সাথে সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু রাজশাহী জেলার [[বাঘা মসজিদ|বাঘা মসজিদ]] এর (১৫২৪) সাথে এর চমৎকার মিল দেখা যায়।  


মসজিদ থেকে একটু দূরে পূর্ব দিকে একটি উন্মুক্ত অঙ্গনে পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত দুটি বর্গাকার কক্ষ রয়েছে। পশ্চিমের কক্ষটিতে দুটি কবর যার একটি জাফর খান গাজীর এবং অপরটি তাঁর স্ত্রীর। পুর্বদিকের কক্ষে পাকা ভিতে চারটি কবর রয়েছে। সমাধিটির দেয়ালগুলি পুরানো মন্দিরের উপকরণ দিয়ে তৈরি, ব্যবহূত পাথরগুলি ছিল আয়তাকার। কক্ষগুলি ছাদবিহীন এবং আকাশের দিকে উন্মুক্ত। ভিতরে প্রবেশের জন্য উত্তর দেয়ালে স্থাপিত একটি কেন্দ্রীয় দরজা রয়েছে, যার উভয় পাশে আয়তাকার অগভীর দুটি কুলুঙ্গি আছে। এগুলির উপরের অংশ ত্রিখাঁজ খিলানে নকশাকৃত। পশ্চিম দিকের কক্ষের উত্তরের দরজা হিন্দু ফ্রেমে তৈরি করা হয়েছে; এতে উৎকীর্ণ দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দিকের কক্ষে [[রামায়ণ|রামায়ণ]] ও [[মহাভারত|মহাভারত]]এর দৃশ্যসম্বলিত ভাস্কর্য দেখা যায়। আরেকটি মূর্তি উল্টো করে ভিতের মধ্যে লাগানো আছে। আশ্চর্যের বিষয় এ যে, এ নিদর্শনটির কাঠামো না একটি মন্দিরের, না একটি মুসলিম সমাধির। মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে সম্ভবত এটা সাময়িক পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল। ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম বিজয়ের অস্থিতিশীল অবস্থা এ প্রস্তাবনাকে সমর্থন করে।  
মসজিদ থেকে একটু দূরে পূর্ব দিকে একটি উন্মুক্ত অঙ্গনে পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত দুটি বর্গাকার কক্ষ রয়েছে। পশ্চিমের কক্ষটিতে দুটি কবর যার একটি জাফর খান গাজীর এবং অপরটি তাঁর স্ত্রীর। পুর্বদিকের কক্ষে পাকা ভিতে চারটি কবর রয়েছে। সমাধিটির দেয়ালগুলি পুরানো মন্দিরের উপকরণ দিয়ে তৈরি, ব্যবহূত পাথরগুলি ছিল আয়তাকার। কক্ষগুলি ছাদবিহীন এবং আকাশের দিকে উন্মুক্ত। ভিতরে প্রবেশের জন্য উত্তর দেয়ালে স্থাপিত একটি কেন্দ্রীয় দরজা রয়েছে, যার উভয় পাশে আয়তাকার অগভীর দুটি কুলুঙ্গি আছে। এগুলির উপরের অংশ ত্রিখাঁজ খিলানে নকশাকৃত। পশ্চিম দিকের কক্ষের উত্তরের দরজা হিন্দু ফ্রেমে তৈরি করা হয়েছে; এতে উৎকীর্ণ দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দিকের কক্ষে [[রামায়ণ|রামায়ণ]] ও [[মহাভারত|মহাভারত]]এর দৃশ্যসম্বলিত ভাস্কর্য দেখা যায়। আরেকটি মূর্তি উল্টো করে ভিতের মধ্যে লাগানো আছে। আশ্চর্যের বিষয় এ যে, এ নিদর্শনটির কাঠামো না একটি মন্দিরের, না একটি মুসলিম সমাধির। মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে সম্ভবত এটা সাময়িক পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল। ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম বিজয়ের অস্থিতিশীল অবস্থা এ প্রস্তাবনাকে সমর্থন করে। [মুহম্মদ হাফিজউল্লাহ খান]
 
[মুহম্মদ হাফিজউল্লাহ খান]


<!-- imported from file: জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ.html-->


[[en:Zafar Khan Ghazi Mosque and Dargah]]
[[en:Zafar Khan Ghazi Mosque and Dargah]]

০৭:০১, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত। স্থাপনা দুটি বাংলায় বিদ্যমান মুসলিম নিদর্শনসমূহের মধ্যে সর্বপ্রাচীন বলে বিবেচিত। একটি শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি ৬৯৭ হিজরি/১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছে। ত্রিবেণী (তিনটি নদীর সঙ্গমস্থল যথা গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এবং এ থেকেই এ নামকরণ) হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট একটি প্রাচীন তীর্থস্থান। মুসলমানগণ তাদের বাংলা বিজয়ের প্রথম দিকে এটি দখল করে।

ভূমি নকশা, জাফর খান গাজী মসজিদ

আয়তাকার মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ২৩.৩৮মি × ১০.৫৩ মি। চুনসুরকির গাঁথনিবিহীন আয়তাকারে কর্তিত পাথর একটির উপর অন্যটির স্থাপনের ঐতিহ্যগত হিন্দুরীতির পরিবর্তে মুসলমানদের প্রবর্তিত ‘ইট ও পাথর’ রীতির এটাই সর্বপ্রাচীন বিদ্যমান নিদর্শন। মসজিদে ব্যবহূত পাথরগুলি হিন্দু মন্দিরের উপকরণ ছিল। কয়েকটি পাথরে খোদাই করা হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এটি প্রমাণ করে। বহুবার সংস্কারের ফলে এ মসজিদের আসল অবয়ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পূর্বদেয়ালে খিলান পদ্ধতিতে তৈরি পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। খিলানগুলি মোটা ও ছোট আকারের ষষ্ঠভুজাকৃতির প্রস্তরস্তম্ভের উপর স্থাপিত। মসজিদটি বাংলায় মুসলিমদের দ্বারা বিকশিত বহুগম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মিত মসজিদের অনুরূপ। এর ছাদের গম্বুজের সংখ্যা, পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথের সংখ্যার সঙ্গে অন্য একপাশের প্রবেশপথের সংখ্যার গুণফলের সমান। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে প্রবেশপথ আছে। ফলে মসজিদটির ছাদে দশটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা দুটি লম্বালম্বি পথ (আইল) এবং পাঁচটি ছোট ‘বে’তে বিভক্ত। ফলে দশটি পৃথক খোপ সৃষ্টি হয়েছে। কোণাসমূহে ইটনির্মিত পেন্ডেন্টিভ দ্বারা প্রস্তরস্তম্ভ ও সূঁচালো খিলানের উপর গম্বুজগুলি স্থাপিত।

সারিবদ্ধ সূঁচালো খিলানে কালো রঙের নকশা মসজিদটির অভ্যন্তরভাগকে প্রশস্ত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে বহুখাঁজ খিলানের মধ্যে পাঁচটি মিহরাব আছে। মিহরাব দেয়ালে প্যানেলের অভ্যন্তরে স্বল্পপরিমাণে নকশা করা হয়েছে। মসজিদের কার্নিস ও প্যারাপেট বাঁকানো নয়। উন্মুক্ত অঙ্গন, রিওয়াক ও মিনারবিহীন শুধু প্রার্থনাকক্ষ সম্বলিত বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী মসজিদ নির্মাণরীতি এ মসজিদে অনুসৃত হয়েছে। এ মসজিদের অভ্যন্তরের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এ যে, এর মাঝবরাবর উত্তর-দক্ষিণের ‘বে’তে একটি দেয়াল খিলানের উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত উঠে গেছে। মসজিদের এ অংশগুলিতেই পোড়ামাটির ফলকের অলঙ্করণ লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণের দেয়ালটি ভালভাবে সংরক্ষিত আছে যা প্যানেলে বিন্যস্ত। মাঝের প্যানেলটিকে গোলাপের নকশাকৃত বর্গাকার ফ্রেম দ্বারা উল্লম্বভাবে দুটি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এর নিচের অংশটি বর্ণাঢ্য পত্ররাজির সঙ্গে প্যাঁচানো আঙ্গুরলতার নকশায় চিত্রিত এবং উপরের অংশটি ঘনপত্ররাজি ও গুল্মের মধ্যে চূড়াসহ দুটি অর্ধখিলান মোটিফে নকশাকৃত। পার্শ্ববর্তী প্যানেলগুলিও একইভাবে অলঙ্কৃত। সব প্যানেলই চূড়াসহ বহুখাঁজ খিলানে নকশাকৃত।

উত্তর ‘বে’-এর অলঙ্করণ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে যেটুকু বিদ্যমান আছে তাতে দক্ষিণ অংশের সাথে পার্থক্য প্রতীয়মান। এ অংশে উল্লম্বভাবে স্থাপিত ছোট দুটি প্যানেল দেখা যায়, যার প্রতিটি চূড়াসহ বহুখাঁজ খিলানে নকশাকৃত এবং চূড়া থেকে একটি শিকল ঝুলন্ত অবস্থায় চিত্রিত যার শেষভাগে গোলাকার ঘণ্টা আছে। এ ‘বে’গুলির উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এগুলি মসজিদের অভ্যন্তর ভাগের নকশার সাথে সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু রাজশাহী জেলার বাঘা মসজিদ এর (১৫২৪) সাথে এর চমৎকার মিল দেখা যায়।

মসজিদ থেকে একটু দূরে পূর্ব দিকে একটি উন্মুক্ত অঙ্গনে পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত দুটি বর্গাকার কক্ষ রয়েছে। পশ্চিমের কক্ষটিতে দুটি কবর যার একটি জাফর খান গাজীর এবং অপরটি তাঁর স্ত্রীর। পুর্বদিকের কক্ষে পাকা ভিতে চারটি কবর রয়েছে। সমাধিটির দেয়ালগুলি পুরানো মন্দিরের উপকরণ দিয়ে তৈরি, ব্যবহূত পাথরগুলি ছিল আয়তাকার। কক্ষগুলি ছাদবিহীন এবং আকাশের দিকে উন্মুক্ত। ভিতরে প্রবেশের জন্য উত্তর দেয়ালে স্থাপিত একটি কেন্দ্রীয় দরজা রয়েছে, যার উভয় পাশে আয়তাকার অগভীর দুটি কুলুঙ্গি আছে। এগুলির উপরের অংশ ত্রিখাঁজ খিলানে নকশাকৃত। পশ্চিম দিকের কক্ষের উত্তরের দরজা হিন্দু ফ্রেমে তৈরি করা হয়েছে; এতে উৎকীর্ণ দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দিকের কক্ষে রামায়ণমহাভারতএর দৃশ্যসম্বলিত ভাস্কর্য দেখা যায়। আরেকটি মূর্তি উল্টো করে ভিতের মধ্যে লাগানো আছে। আশ্চর্যের বিষয় এ যে, এ নিদর্শনটির কাঠামো না একটি মন্দিরের, না একটি মুসলিম সমাধির। মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে সম্ভবত এটা সাময়িক পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল। ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম বিজয়ের অস্থিতিশীল অবস্থা এ প্রস্তাবনাকে সমর্থন করে। [মুহম্মদ হাফিজউল্লাহ খান]