জাদুঘর উপকরণ সংরক্ষণ
জাদুঘর উপকরণ সংরক্ষণ জাদুঘরে প্রদর্শিত শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক অথবা বৈজ্ঞানিক গুরুত্বসম্পন্ন উপকরণসমূহকে ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার প্রক্রিয়া। জাদুঘর উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত হয় সে সকল বস্ত্ত যা অন্তত শতাধিক বৎসর প্রাচীন এবং যার সাথে শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, দর্শন এবং মানুষের সামাজিক জীবনের যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জাদুঘরে সংরক্ষিত উপকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে তালপাতা, গাছের বাকল এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে তৈরি কাগজে লিখিত পান্ডুলিপি, সনদ, ফরমান, দাপ্তরিক নথিপত্র, বইপত্র, পত্রিকা, মানচিত্র, রেখাচিত্র, চিত্রকর্ম; হাতির দাঁতের তৈরি সিংহাসন, মাদুর, গয়নার বাক্স, খেলনা সামগ্রী; কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, স্থাপত্যকর্ম, প্রতিমা; বিচিত্র নকশার টেরাকোটা, মৃৎপাত্র; ধাতব পদার্থের তৈরি গৃহস্থালী তৈজসপত্র, বাসনকোসন, মূর্তি-প্রতিমা, মুদ্রা, তলোয়ার, ছুরি, বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, তাম্রপত্র; পাথরের তৈরি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, লিপিকলা সম্বলিত স্থাপত্যকর্ম ইত্যাদি। এগুলোর সবই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। এসকল ঐতিহ্যবাহী উপকরণের বেলায় সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পূর্বে সুনির্দিষ্টভাবে জানা দরকার এসব উপকরণসমূহের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আসল কারণসমূহ সম্পর্কে। সংরক্ষণ ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে জাদুঘর উপকরণসমূহকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়: (ক) জৈব নিদর্শনসমূহ এবং (খ) অজৈব নিদর্শনসমূহ।
অজৈব নিদর্শনসমূহের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণসমূহ বাংলাদেশের চরম গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু জৈব নিদর্শনসমূহ, বিশেষ করে, যেসব উপকরণের উৎস সেলুলোজ সেসব উপকরণ বিভিন্ন ছত্রাক (পেনিসিলিয়াম, অ্যাসপারগিলাস-এর বিভিন্ন প্রজাতিসমূহ), ব্যাকটেরিয়া, কীট (বইপত্রের জন্য ক্ষতিকারক পোকা, উকুন, মথ), পোকামাকড় (ঘুণ পোকা, কার্পেট এবং আসবাবপত্রের পোকা) এবং পতঙ্গ (সিলভার ফিশ পতঙ্গ, উইপোকা, আরসোলা), ছোট প্রাণী (ইদুর ও ছুঁচো) প্রভৃতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এর ফলে উপকরণসমূহে বিভিন্ন বর্ণের দাগ পড়া, অম্লায়িত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়া, উপকরণসমূহের তন্তুগুলোর শক্তি হ্রাস পাওয়া, বিভিন্ন অংশ ক্ষয়ে যাওয়া প্রভৃতি ঘটনা ঘটে। সূর্যালোক, কৃত্রিম আলোকব্যবস্থা, তাপ ও উচ্চ আর্দ্রতা, মরিচা পড়া এবং আলোক জারণ প্রতিক্রিয়ার মতো ভৌত ক্রিয়ার প্রভাবে জাদুঘর উপকরণসমূহে বিবর্ণতা, কাঠিন্য, হলদে ও বাদামি দাগ পড়া, তন্তুর দৌর্বল্য, ভঙ্গুরতা প্রভৃতি দেখা দেয়। নিদর্শনসমূহের প্রধান উপাদান সেলুলোজ থেকে উৎপন্ন অ্যালডিহাইড, কিটোন, কার্বক্সিলিক এসিড এবং অ্যামিনো এসিড হাইড্রোক্লোরাইড এর মতো যৌগসমূহের ক্ষুদ্র শৃঙ্খল সৃষ্টি হওয়ার কারণে এ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ধাতব বস্ত্তসমূহের ক্ষতিগ্রস্ততার কারণসমূহ বৎসরের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে বিরাজমান উচ্চমাত্রার আর্দ্রতা ধাতব বস্ত্তর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। আর্দ্র মৌসুমে জাদুঘরের লোহা, তামা, সীসা এবং তাদের মিশ্রণে নির্মিত দ্রব্যে অক্সিজেন যুক্ত হওয়ার ফলে বস্ত্তসমূহের উপরে ক্ষয়কারী একটি স্তর সৃষ্টি হয় যা ক্রমশ ধাতুর মূল অংশের দিকে অগ্রসর হয় এবং মূল অংশটি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ফলে বস্ত্তগুলি বিকৃত হয়ে যায়। শহরাঞ্চলে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার দ্বারা বায়ুতে সালফার বিদ্যমান থাকে। এতে শহর এলাকায় অবস্থিত জাদুঘরের রৌপ্যনির্মিত উপকরণসমূহের উপর সিলভার সালফাইডের একটি পাতলা আবরণ সৃষ্টি হয়, যার ফলে এগুলো সহজেই কালচে বর্ণ ধারণ করে। রৌপ্যনির্মিত ও ক্লোরাইডযুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের উপরের স্তরে ক্লোরাইড স্থানান্তরিত হয়ে সিলভার ক্লোরাইড উৎপন্ন হওয়ার ফলে এগুলো ক্রমশ ধূসর ও মৃত্তিকাবর্ণ ধারণ করে।
প্রস্তরনির্মিত উপকরণসমূহের ক্ষতিগ্রস্ততার কারণসমূহ শহুরে পরিবেশে জাদুঘরের বেলেপাথর এবং চুনাপাথরের নিদর্শনসমূহে সালফার ডাই অক্সাইড যুক্ত থাকে যা পরবর্তীতে সালফিউরিক এসিডে রূপান্তরিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ক্যালসিয়াম সালফেট বস্ত্তর বহির্ভাগকে এমন মাত্রায় দুর্বল করে যে তা প্রায় ঝুরঝুরে হয়ে যায়। প্রস্তরনির্মিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমুহ জাদুঘরের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার উঠানামার শিকার হয় এবং এতে প্রস্তরে বিদ্যমান দ্রবণীয় লবণসমূহ পাথরের বহির্ভাগে তাদের ধর্মানুসারে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে এরা স্ফটিকায়িত হয় এবং কখনও কখনও শক্ত আকার ধারণ করে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ফটিক সুতার আকার ধারণ করে যা লোমকূপ থেকে বেরিয়ে আসা লোমের মত দেখতে। স্ফটিকের বৃদ্ধি বস্ত্তর প্রসারণ ঘটায় যার ফলে বহির্ভাগে ভঙ্গুরতা দেখা দেয় এবং পরিণতিতে তা ভেঙ্গে যায়। এ কারণে পাথুরে বস্ত্তর উপর বিস্তৃত অলঙ্করণ মুছে যায় এবং খোদাইকৃত শিলালিপি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
জাদুঘর উপকরণসমূহের রোগবালাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে রক্ষিত তালপাতা, গাছের বাকল ও কাগজের উপকরণ, পশুচর্মে লিখিত পান্ডুলিপি, চামড়া এবং কাষ্ঠনির্মিত বস্ত্তসমূহে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই দেখা দেয়। এসকল রোগবালাই-এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণ, স্যাঁতসেঁতে অবস্থা, তন্তুর দুর্বল হয়ে পড়া, অম্লায়ন, সকল উপকরণ হলদে বা বাদামি বা কালচে হয়ে যাওয়া, শক্ত হয়ে উঠা, ভঙ্গুরতা এবং অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র দেখা দেওয়া প্রভৃতি। ধাতব বস্ত্তসমূহের একটি সাধারণ রোগ হচ্ছে ক্ষয়। লৌহজাত দ্রব্যে মরিচা এবং সাদা কঠিন আবরণ পড়া; তামা এবং এর মিশ্রণজাত বস্ত্তর উপর কালো প্রলেপ পড়া, ব্রোঞ্জ ও পিতলের উপর পান্ডুর সবুজাভ গুড়ো দাগ (ব্রোঞ্জ রোগ) পড়া; রৌপ্যদ্রব্যের নিষ্প্রভতা; কালো আগ্নেয়শিলা নির্মিত বস্ত্তর উপর লালচে হলুদ স্তর পড়া; স্যাঁতসেঁতে ভাব, বর্হিভাগে সাদা গুড়ো পড়া, বেলেপাথরের বস্ত্তর বহির্ভাগ ঝুরঝুরে হয়ে পড়া এবং ভেঙ্গে যাওয়া; প্রস্তরনির্মিত বস্ত্তর উপর শৈবাল জন্মানো, পুষ্পল ছত্রাক জমা এ সবগুলোই অজৈব নিদর্শনসমূহের অবস্থার অবনতি ঘটায়।
সংরক্ষণ পদ্ধতি বা কৌশল বাংলাদেশে জাদুঘর উপকরণসমূহের সংরক্ষণের জন্য দেশিয় কৌশল এবং আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত- এ দুই ধরনের সংরক্ষণ কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
দেশিয় কৌশল দেশে উদ্ভাবিত এবং প্রচলিত নিজস্ব সংরক্ষণ কৌশল। প্রাচীন কালে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা, ছত্রাক (স্থানীয়ভাবে যাকে ‘ছাতা’ বলা হয়) আক্রমণ এবং বইপত্র, জামাকাপড়, আসবাবপত্র, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী প্রভৃতির অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ (স্থানীয়ভাবে যাদেরকে ‘পোকা’ বলা হয়) সম্পর্কে জনগনের ধারণা ছিল। আর্দ্র মৌসুমে যখন এসব উপকরণ স্যাঁতসেঁতে অবস্থা, ছত্রাক ও কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হতো, সেক্ষেত্রে তারা উপকরণসমূহকে রক্ষার জন্য রৌদ্রালোকে মেলে দিতো। কিছু সময় রৌদ্রে রাখার পর তা আবার সরিয়ে এনে কাপড় দিয়ে ভালভাবে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে শুষ্ক ও নিরাপদ স্থানে রেখে দিতো। বাঁশ এবং বেতের সামগ্রী ঘূণ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হলে কেরোসিন তেল ব্যবহূত হতো। কেরোসিনে ভেজানো এক টুকরো কাপড়ের সাহায্যে এসব উপকরণকে সিক্ত করার পর কিছুক্ষণ সূর্যালোকে রেখে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা হত। এছাড়া পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ ধ্বংসের জন্য অন্য একটি ব্যবস্থা ছিল। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত উপকরণসমূহকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় খড়কুটা ও শুকনো পাতা পুড়িয়ে ঘন ধোঁয়ার মধ্যে কিছু সময় রেখে দেওয়া হতো এবং পরবর্তীতে কেরোসিন দ্বারা পরিষ্কার করা হতো। পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কাঠের আসবাবপত্র এক থেকে দুই মাস পানির নিচে ডুবিয়ে রাখার পর ঘরের তাপমাত্রায় শুকিয়ে পুনরায় কপার সালফেট মেশানো পানিতে ভিজিয়ে শুকানো হতো। এ ব্যবস্থায় এসব উপকরণ দীর্ঘদিন নিরাপদ থাকত। হাতে তৈরি কাগজে লিখিত প্রাচীন পান্ডুলিপিগুলো দেখতে হলুদ ও বাদামি রঙের ছিলো, কারণ ছত্রাক ও কীটপতঙ্গের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য হলুদের দ্রবণ এবং তেঁতুল ও হরিতকির বীজ চূর্ণ করে তৈরি মন্ড দ্বারা কাগজকে প্রতিরোধী করা হতো। কাপড় থেকে ময়লা দূর করার জন্য কলাগাছ পোড়ানো ছাই এবং পানির মধ্যে কাপড়টিকে সিদ্ধ করে পরবর্তীতে পুকুর অথবা নদীর পানিতে ধূয়ে সরাসরি সূর্যের আলোতে শুকানো হতো।
লৌহনির্মিত নির্দশনসমূহ মরিচা এবং ক্লোরাইড স্তর পড়ার কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে পাতলা মরিচাস্তর পরিষ্কার করার জন্য ঝামা (অতিরিক্ত পোড়ানো ইটের কালো অংশ) এবং বালি দ্বারা ঘষা হতো। লৌহনির্মিত নিদর্শনের বহির্ভাগে জমা ধুলার স্তর কাপড় দ্বারা ঝেড়ে ফেলা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিক মরিচা পড়া বস্ত্তসমূহকে এক অথবা দুইদিন কেরোসিন তেলে ডুবিয়ে রাখা হতো যাতে মরিচা নরম হয়ে আসে এবং সহজে ঘষে তুলে ফেলা যায়, পরবর্তীতে কেরোসিন তেলে ধুয়ে পরিষ্কার করা হতো। আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করার জন্য কক্ষ তাপমাত্রায় বস্ত্তগুলোকে শুকানোর পর চর্বি অথবা ভেসলিন অথবা গলিত মোম মাখিয়ে রাখা হতো। ক্ষয়প্রাপ্ত তামা, ব্রোঞ্জ এবং পিতলের দ্রব্যাদির ক্ষয়প্রতিরোধে প্রথমত পাকা তেঁতুল ও পানির দ্রবণে সেগুলোকে ডুবিয়ে নিয়ে ঘষে ফেলা হতো। এরপর পানিতে ধুয়ে কক্ষ তাপমাত্রায় শুকানো হতো। অতঃপর দ্রব্যগুলোকে গ্রিজ অথবা সরিষার তেল মাখিয়ে রাখা হতো। স্বর্ণ এবং রৌপ্যনির্মিত অলঙ্কারসমূহকে প্রথমে এক থেকে দুইদিন তেঁতুল দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা হতো। এরপর পরিষ্কার করে নিয়ে ঘষে পানি দ্বারা ধুয়ে কক্ষ তাপমাত্রায় শুকানো হতো।
প্রাচীন যুগে কাপড় ও কাগজের উপকরণসমূহ পোকামাকড় এবং কীটপতঙ্গ থেকে মুক্ত রাখার জন্য সংরক্ষণস্থলে পাতাসহ নিমের ছোট একটি ডাল এবং কখনও কখনও কাপড়ের পুটলিতে কালিজিরা ঝুলিয়ে রাখা হতো। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ন্যাপথালিনের টুকরা বা গুলি এ কাজে ব্যবহূত হতে থাকে। ছোট কাপড়ের থলেতে এসব ন্যাপথালিনের টুকরা বইপত্র বা কাপড় ভর্তি শোকেস অথবা আলমারিতে কীটপতঙ্গ বিতাড়ক হিসেবে ব্যাপকহারে ব্যবহূত হতে থাকে। আজ পর্যন্ত এর ব্যবহার অব্যাহত আছে।
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ ও গবেষণা পরীক্ষাগার এবং প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনস্থ প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ পরীক্ষাগারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত জাদুঘর এবং সংরক্ষণশালাসমূহে সংরক্ষিত নিদর্শনাদির বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এ পরীক্ষাগার দুটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো যথাসময়ে এবং যথাযথ রাসায়নিক প্রক্রিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহ সংরক্ষণ। বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমের কোনো স্তরেই বিষয় হিসেবে সংরক্ষণবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত হয় নি, ফলে স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে গৃহীত জাদুঘর উপকরণসমূহ সংরক্ষণ-কৌশল মূলত বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত। বাংলাদেশে জাদুঘর নিদর্শনসমূহের জন্য নির্ধারিত সংরক্ষণপ্রণালী নিম্নে বিবৃত হলো:
সেলুলোজ তৈরি জাদুঘর উপকরণ সংরক্ষণ কাগজ, কাপড়, এবং কাঠনির্মিত উপকরণসমূহের প্রধান উপাদান হলো সেলুলোজ। সেলুলোজ তৈরি জাদুঘর নিদর্শনসমূহের রোগ ও ক্ষয়রোধে ব্যবহূত সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার প্রণালী নিম্নে উল্লেখ করা হল:
বাষ্প ধৌতকরণ এ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকারক ছত্রাক, পোকামাকড় এবং কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা হয়। এছাড়া কীটনাশক স্প্রে করে কার্যকরভাবে ঘুণপোকা, উইপোকা ও আরসোলা ধ্বংস করা হয়ে থাকে।
পরিষ্কারকরণ ভৌত ও রাসায়নিক- এ দুই উপায়ে নিদর্শনসমূহ পরিষ্কার করা হয়ে থাকে। রাসায়নিক পরিষ্কারকরণ আবার দুই ধরনের: (১) জলীয় ধৌতকরণ এবং (২) অ-জলীয় ধৌতকরণ।
অম্লমুক্তকরণ (deacidification) পরিষ্কার করার পর যদি উপকরণসমূহে অম্লের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় সেক্ষেত্রে অম্লমুক্তকরণের প্রয়োজন হয়। দুই ধরনের অম্লমুক্তকরণ প্রণালীর মধ্যে একটি হচ্ছে জলীয় অম্লমুক্তকরণ এবং অন্যটি হচ্ছে অ-জলীয় অম্লমুক্তকরণ।
পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা সেলুলোজসমৃদ্ধ উপকরণসমূহের ক্ষেত্রে অনেক প্রকার পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যেমন: পেস্টিং, লেমিনেশন, বাঁধাই, তালি দেওয়া, কাপড়ের আস্তরণ দেওয়া, বিন্যস্ত করা, পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে দৃঢ়ীকরণ এবং পরিপূর্ণকরণ।
লেমিনেশন কাগজের উপকরণ সংরক্ষণ উপায় হিসেবে লেমিনেশন একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ বিজ্ঞানীরা দ্রাবক লেমিনেশনের পক্ষপাতি, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ বিজ্ঞানীরা তাপীয় লেমিনেশন অনুসরণ করে থাকেন।
অক্সিডেন্ট প্রতিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেলুলোজ নির্মিত নিদর্শনাদি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রধান কারণসমূহের একটি হচ্ছে অক্সিডেশন বা জারণ। নিদর্শনসমূহে জারণক্রিয়া প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে জাতীয় জাদুঘরের গবেষণা ও সংরক্ষণ পরীক্ষাগারে অক্সিডেন্ট প্রতিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
অজৈব নিদর্শনাদির সংরক্ষণ বিভিন্ন প্রকার অজৈব নিদর্শনাদির সংরক্ষণ প্রণালী নিম্নে বিবৃত করা হলো।
ধাতববস্ত্তর সংরক্ষণ লৌহ এবং সীসার উপর পড়া অক্সাইডের পাতলা প্রলেপকে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইডের পাতলা জলীয় দ্রবণ সহযোগে অাঁচড়ে তুলে ফেলা হয় এবং তামার দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে সালফিউরিক এসিডের পাতলা জলীয় দ্রবণ ব্যবহূত হয়। নিষ্প্রভ হয়ে পড়া রৌপ্যনির্মিত দ্রব্যাদি পরিষ্কার করা হয় হাইড্রোক্লোরিক এসিডের জলীয় দ্রবণ এবং ইডিটিএ (ডাইসোডিয়াম ডাইহাইড্রোজেন ইথিলিন ডিঅ্যামাইন টেট্রা এসিটিক এসিড) সহযোগে। উপরের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে উষ্ণ পাতিত পানি দ্বারা পর্যাপ্ত ধৌতকরণ, শুষ্ককরণ এবং ইরেলাইন বার্নিশের (Erealine lacquer) প্রলেপ প্রয়োজনীয় বিষয়। ব্রোঞ্জনির্মিত দ্রব্যের রোগ বা ক্ষয় প্রতিরোধে মেথিলেটেড স্পিরিটে সিলভার অক্সাইডের মন্ড ব্যবহূত হয়ে থাকে।
ধাতব দ্রব্যে ক্লোরাইড বা সালফেট সৃষ্ট পুরু ক্ষয়কারী স্তর দূরীভূত করতে তড়িৎ বিজারণ (electrolytic reduction) পদ্ধতি অনুসৃত হয়। এক্ষেত্রে শতকরা ৫ ভাগ সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড তড়িৎ বিশ্লেষ্য (electrolyte) হিসেবে এবং ইস্পাতের পাত বা দন্ড ধন-তড়িৎদন্ড (anode) হিসেবে ব্যবহূত হয়। তড়িৎ বিশ্লেষণের (electrolysis) পরে নরম হয়ে পড়া ক্ষয়কারী স্তর ট্যাপের পানির ধারা সহযোগে দূর করা হয় এবং শেষে উষ্ণ বিশুদ্ধ পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলা হয়। অতঃপর দ্রব্যটিকে ওভেনে শুকানো হয় ও বার্নিশের প্রলেপ দেওয়া হয়।
প্রস্তরনির্মিত এবং টেরাকোটা উপকরণ সংরক্ষণ পাললিক শিলানির্মিত উপকরণসমূহের বহির্ভাগে ভঙ্গুরতার সৃষ্টি হয়ে সেগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। এসকল নিদর্শনের উপাদানসমূহের মধ্যকার জোড়ক পদার্থ বা সিমেন্ট কোনো কারণে দুর্বল হয়ে গেলে উপাদানসমূহের মধ্যকার সংহতি বিনষ্ট হয় এবং উপাদানগুলি মুক্ত হয়ে চূর্ণ হয়ে যায়। যদি সালফার ডাই অক্সাইড সমৃদ্ধ বেলেপাথর বা চুনাপাথর নগরীয় পরিবেশে উন্মুক্ত থাকে তাহলে তাতে বিদ্যমান সালফার ডাই অক্সাইড সালফিউরিক এসিডে রূপান্তরিত হয় এবং এ থেকে উৎপন্ন ক্যালসিয়াম সালফেট দ্রুত দ্রব্যের বহির্ভাগকে এমন মাত্রায় দুর্বল করে ফেলে যে বহির্ভাগে ভঙ্গুরতার সৃষ্টি হয়।
দ্রবণীয় লবণের অপসারণ পাথর এবং টেরাকোটা উপকরণের মধ্যে থাকা দ্রবণীয় লবণসমূহ তরলান্তর পদ্ধতি (immersion method) অথবা নিষ্কাশন পদ্ধতিতে অপসারণ করা হয়।
স্যাঁতসেঁতে অবস্থা এবং আগাছা অপসারণ স্মৃতিসৌধ অথবা পুরানো দালান কোঠায় স্যাঁতসেঁতে অবস্থা দূর করার জন্য পাকা তেঁতুল মিশ্রিত পানি ছিটানো হয়। অন্য একটি উপায় হচ্ছে বার্জারের সিলিকন রঙ ব্যবহার করার মাধ্যমে। রঙের স্তরটি আর্দ্রতাকে রোধ করে থাকে। মস, শৈবাল, পুষ্পল ছত্রাক এবং অন্যান্য উদ্ভিদ নির্মাণকর্মের বহির্ভাগের পাথর বা টেরাকোটা ফলকে বিস্তার লাভ করে। এসব ধ্বংস করতে আর্সেনিক অক্সাইড অথবা সোডিয়াম বেনজোয়েট ব্যবহূত হয়।
সুদৃঢ়করণ পাথর অথবা টেরাকোটা থেকে লবণ অপসারণ করার পর, এর বর্হিভাগকে শক্তিশালীকরণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। তার্পিন তেলে মৌচাকের মোম, এলকোহলে সাদা চাঁচগালা, টলুইনে বা এসিটোনে সেলুলোজ নাইট্রেট এবং পলিভিনাইল এসিটেট মিশিয়ে এ কাজটি সম্পন্ন করা হয়। বেলেপাথর অথবা সিলিকা চুনাপাথর নির্মিত ফলকসমূহের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সুদৃঢ়করণ উপাদান হল সিলিকন ইস্টার বা ইথাইল এলকোহলে ইথাইল সিলিকেটের একটি দ্রবণ। [মোঃ ছাবের আলী]
আরও দেখুন গ্রন্থাগার উপকরণ সংরক্ষণ।